বিনোদনের আড়ালে মানসিক বিপ্লব?-'পর্নোগ্রাফি ও মিডিয়া' বিশ্লেষণে উঠে এসেছে নয়া বাস্তবতা

বিনোদনের আড়ালে মানসিক বিপ্লব?-'পর্নোগ্রাফি ও মিডিয়া' বিশ্লেষণে উঠে এসেছে নয়া বাস্তবতা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ইন্টারনেটের দ্রুত বিস্তারে পর্নোগ্রাফি এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। ব্যক্তিগত বিনোদন থেকে শুরু করে সামাজিক মনস্তত্ত্ব পর্যন্ত, এটি এখন বিশ্বব্যাপী গবেষণার অন্যতম আলোচিত ক্ষেত্র। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গবেষণা বইগুলো জানাচ্ছে, পর্নোগ্রাফি কেবল যৌনতার বিষয় নয়, এটি আজ মানুষের মানসিক আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, আত্ম-ইমেজ, এমনকি নৈতিক মানসিকতা পর্যন্ত প্রভাব ফেলছে।

দুইটি সাম্প্রতিক গবেষণামূলক বই-
 

১। 'Youth and Internet Pornography: The Impact and Influence on Adolescent Development' (Richard J. Behun & Eric W. Owens, 2020)
এবং
 

২। 'What Do We Know About the Effects of Pornography After Fifty Years of Academic Research?' (Alan McKee et al., 2022)

- বিশ্বজুড়ে ৫০ বছরের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।

দুটি বই-ই স্পষ্ট করেছে, ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি এখন শুধু বিনোদনের নয়, বরং মানব সমাজের এক দার্শনিক ও সামাজিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
 

প্রথম বই Youth and Internet Pornography বিশ্লেষণ করেছে, কীভাবে কিশোর-কিশোরীরা অনলাইন পর্নোগ্রাফির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় এবং সেটি তাদের মানসিক বিকাশে কী প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় দেখা গেছে—কিশোর বয়সে পর্নোগ্রাফি দেখা সাধারণত কৌতূহল থেকে শুরু হলেও তা ধীরে ধীরে "অভ্যাসে" পরিণত হয়। এই অভ্যাস অনেকে নিজের শরীর, যৌনতা ও সম্পর্ক নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি করে। ভার্চুয়াল সন্তুষ্টি বাস্তব সম্পর্কের গভীরতাকে কমিয়ে দেয়। বইটিতে বলা হয়েছে, "ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি তরুণ মস্তিষ্কে ডোপামিন নির্ভর আনন্দ তৈরি করে, যা দ্রুত উত্তেজনা দেয় কিন্তু স্থায়ী মানসিক পরিতৃপ্তি দেয় না।" ফলে অনেক তরুণ বাস্তব সম্পর্কের চেয়ে ভার্চুয়াল কল্পনায় বেশি স্বস্তি খোঁজে। এই গবেষণায় আরও দেখা যায়, মিডিয়া ও প্রযুক্তি যেভাবে সহজে যৌন কনটেন্ট পৌঁছে দিচ্ছে, তাতে গোপনতা ভেঙে গেছে, কিন্তু সচেতনতা তৈরি হয়নি।

দ্বিতীয় বইটিতে Alan McKee ও তাঁর সহলেখকরা তাঁদের বইতে তুলে ধরেছেন, "পর্নোগ্রাফি ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলে" সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণায় একমত হওয়া যায়নি। তবে কিছু সাধারণ ফলাফল স্পষ্ট:

পর্নোগ্রাফি দেখা তাৎক্ষণিক আনন্দ দিলেও, এটি মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম- কে পরিবর্তন করে। গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত পর্ন ব্যবহারে মনোযোগ কমে, আবেগের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়, এবং বাস্তব সম্পর্ক থেকে আগ্রহ হারায়।
 

অনেক তরুণ বা প্রাপ্তবয়স্ক মনে করে, বাস্তব জীবনেও পর্নে দেখা পারফেকশন পাওয়া উচিত। ফলে সম্পর্কে শুরু হয় অসন্তুষ্টি, অবিশ্বাস, মানসিক টানাপোড়েন। বিশেষ করে দাম্পত্য সম্পর্কে, এটি এক নীরব দূরত্ব তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখা মানুষকে নিজের শরীর বা চেহারা নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন করে তোলে। নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কম্প্যারিজন কমপ্লেক্স তৈরি হয়, নিজেকে যথেষ্ট মনে না হওয়া, যা আত্মসম্মানহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। পশ্চিমা বিশ্বে গবেষণা তুলনামূলক মুক্ত হলেও, এশীয় সমাজে বিষয়টি এখনো নিষিদ্ধ আলোচনার মতো। ফলে এখানে তথ্যের ঘাটতি, সচেতনতার অভাব ও ভুল ধারণা একসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

কেবল নিষেধ নয়, প্রয়োজন 'মিডিয়া লিটারেসি'!

দুই বই-ই জোর দিয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে -"পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করলেই সমস্যা মেটে না; বরং সচেতনতা ও শিক্ষা বাড়ানোই সমাধান।"

Youth and Internet Pornography বলছে, অভিভাবক ও শিক্ষকদের উচিত কিশোরদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা-যেন তারা যৌনতা, সম্পর্ক ও মর্যাদার পার্থক্য বুঝতে পারে। অন্যদিকে McKee-এর গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে , মিডিয়া লিটারেসি অর্থাৎ মিডিয়া বোঝার শিক্ষা,  স্কুলে শেখানো হয়, সেখানে তরুণদের মধ্যে অন্ধ অনুকরণ বা বিকৃত ধারণা অনেক কম। এমনকি কিছু গবেষণা বলছে, তথ্য ও শিক্ষার অভাবই অবচেতন অপরাধবোধ তৈরি করে, যা মানসিকভাবে আরও ক্ষতিকর।

গবেষকরা বলছেন, পর্নোগ্রাফি আসলে সমাজের এক প্রতিফলন।
যে সমাজে নারী বা যৌনতা ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়, সেখানে পর্নোগ্রাফি হয়ে ওঠে গোপন বিকল্প শিক্ষা, যা আবার ভুল বার্তা দেয়।অন্যদিকে যেসব সমাজে যৌনতা নিয়ে উন্মুক্ত, সেখানেও সমস্যা থাকে-অতিরিক্ত ভোগবাদ, অবাস্তব প্রত্যাশা, মানসিক চাপ।তাই প্রশ্নটি "পর্ন ভালো না খারাপ" নয়, বরং আমরা কীভাবে এটাকে দেখি, এবং কীভাবে শিখি- সেটাই আসল।
 

এই আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে যে বার্তাটি সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে উঠে আসে, তা হলো- "অজ্ঞতা নয়, সচেতনতা" হতে হবে প্রতিরোধের পথ।

মিডিয়ার যুগে নিয়ন্ত্রণ কঠিন, কিন্তু নিজস্ব সচেতনতা, শিক্ষা এবং মানসিক ভারসাম্যই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য দরকার এমন এক শিক্ষা যেখানে যৌনতা, সম্পর্ক, সম্মান, ও বাস্তব জীবনের মূল্যবোধ সবকিছুর ভারসাম্য শেখানো হবে।মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন,যৌনতা মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা, কিন্তু মিডিয়ার বিকৃত উপস্থাপন সেটাকে অস্বাভাবিক করে তোলে।সেই বিকৃতি শুধরানো সম্ভব একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে।

পর্নোগ্রাফি আজকের বিশ্বের এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। প্রযুক্তি, মিডিয়া ও মানবমন-তিনটি ক্ষেত্রের সংযোগে এটি তৈরি করেছে নতুন প্রশ্ন, নতুন জটিলতা।কিন্তু নিষেধাজ্ঞা বা ভয় নয়, এই বাস্তবতার সামনে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিক্রিয়া হলো বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়া, সংবেদনশীল শিক্ষা ও সামাজিক সংলাপ। এই দুই আন্তর্জাতিক বই একটাই শিক্ষা দেয়, মানুষ যদি নিজেকে বোঝে, তবে মিডিয়া তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ