ভূপৃষ্ঠের গভীরে শত বছরের চাপ, আর তার কয়েক সেকেন্ডের মুক্তি-ভূমিকম্পের জন্ম সেখানেই!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
সকালে স্বাভাবিকভাবে শুরু হওয়া একটি দিন, হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠতে শুরু করে। ঘরের জানালা কাঁপে, আলো ফ্লিক করে, মানুষের বুক ধুকপুক করে ওঠে। কয়েক সেকেন্ডের এই অস্থিরতা যেন পৃথিবীর এক অদৃশ্য রোষ। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞান বহুগুণ বেশি জটিল। ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর গভীরে জমে থাকা শক্তির দীর্ঘদিনের সঞ্চয়,যা আকস্মিকভাবে মুক্তি পায়। এই শক্তির জন্ম মাটির অনেক নীচে, যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, ঘষে, আটকে থাকে, আবার হঠাৎ সরে যায়।এই বিস্ফোরণ-ধর্মী শক্তির মুক্তি আমাদের অনুভবে আসে কেঁপে ওঠা পৃথিবী হিসেবে। আর এই কাঁপুনি শুধু ভূগোল নয়, মানুষের জীবন, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও নগরায়ণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।
পৃথিবীর পৃষ্ঠ আসলে একটি বিশাল একটানা খোল নয়; এটি বহু বড়-বড় স্ল্যাব বা প্লেটে বিভক্ত, যাকে বলা হয় "টেকটনিক প্লেট"। প্রতিটি প্লেট বছরে কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত নড়াচড়া করে। এই নড়াচড়া যদিও আমাদের চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু পৃথিবীর অভ্যন্তরের উত্তাপ, ম্যাগমার গতিবিধি ও কনভেকশনের ফলে প্লেটগুলো ক্রমাগত চলতে থাকে- কখনো ধীরে, কখনো আটকে থেকে, আবার কখনো হঠাৎ ছিঁড়ে গিয়ে। তিন ধরনের গতিবিধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টি করে-
➤ ধাক্কা লাগা (Convergent Boundary) – দুটি প্লেট মুখোমুখি সংঘর্ষে যায়।
➤ দূরে সরে যাওয়া (Divergent Boundary) – প্লেট আলাদা হয়ে ফাটল তৈরি করে।
➤ আড়াআড়ি ঘষা (Transform Boundary) – প্লেট পরস্পরের পাশ ঘেঁষে ঘষতে ঘষতে একসময় হঠাৎ ছিটকে যায়।
প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অভ্যন্তরের শক্তি জমতে থাকে। যখন এই শক্তি ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখনই ভূমিকম্প জন্ম নেয়।
ফল্টলাইন—পৃথিবীর নীচের লুকানো ক্ষতচিহ্ন!
ফল্টলাইন হলো পৃথিবীর ভূত্বকের সেই দুর্বল অংশ যেখানে প্লেটগুলো আটকে থেকেও চাপ জমিয়ে রাখে। এই জায়গাগুলোকে সহজ ভাষায় বলা যায় "মাটির নিচের দাগ", যেখান থেকে ভূমিকম্প জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চাপ যত বাড়ে, ততই ফল্টলাইনের পাথরগুলো দুর্বল হয়। অবশেষে এক মুহূর্তে তা ভেঙে যায় আর এই ভাঙন থেকেই ভূমিকম্পের তরঙ্গ সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভূমিকম্প শুধু কাঁপুনি নয়; এটি বিশুদ্ধ শক্তির গতিবেগ। ভূমিকম্প হলে দুটি বড় ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়-
☞ প্রাথমিক তরঙ্গ (P-Wave),যা সবচেয়ে দ্রুতগামী। এটি কঠিন ও তরল-দুই মাধ্যমেই ছড়াতে পারে। ভবনকে সামনে–পেছনে দুলিয়ে দেয়।
☞ গৌণ তরঙ্গ (S-Wave) যা, তুলনামূলক ধীর, কিন্তু সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। এটি শুধু কঠিন মাধ্যমেই চলতে পারে।ভূমি উপরে-নিচে বা সাইডওয়েতে দুলিয়ে ফেলে।
এরপর আসে সারফেস ওয়েভ,যা মাটির ওপরে ছড়িয়ে পড়া তীব্র কম্পন তৈরি করে এবং ভবন ধসে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেন কিছু ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড, আবার কিছু মিনিট ধরে কাঁপে?
এটি নির্ভর করে- ফল্টলাইনের দৈর্ঘ্য কত বড়,চাপ কতদিন ধরে জমে ছিল, ভাঙন কতটা গভীর থেকে শুরু হয়েছে অথবা তরঙ্গের গতিবেগ কত বেশি।বড় ফল্টলাইন ছিঁড়ে গেলে কম্পন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
মাত্রা (Magnitude) বনাম তীব্রতা (Intensity) - ভুল বোঝাবুঝির শেষ নেই!
অনেকেই মনে করেন রিখটার স্কেলই তীব্রতা বোঝায়-এটি ভুল।Magnitude হলো ভূমিকম্প কত শক্তিশালী ছিল (ভূমিকম্পের উৎসে)।আর Intensity হলো নির্দিষ্ট এলাকায় মানুষ কতটা কম্পন অনুভব করেছে। একই ভূমিকম্পে বিভিন্ন এলাকায় তীব্রতা ভিন্ন হয়। যেমন- মাটির ধরন, ভবনের নির্মাণশৈলী, ঘনত্ব-সবই প্রভাব ফেলে।
কেন ভূমিকম্প আগে থেকে জানা যায় না?
ভূমিকম্প পূর্বাভাস পৃথিবীর বিজ্ঞানের সবচেয়ে কঠিন অংশগুলোর একটি। কারণ-
◑ ভূগর্ভে কী হচ্ছে তা সরাসরি দেখা অসম্ভব।
◑ চাপ জমার গতি স্থির নয়।
◑ ফল্টলাইনের ভাঙনের সময় নির্ধারণ করা যায় না।
◑ পৃথিবীর অভ্যন্তর অত্যন্ত জটিল ও বহুপদ স্তরবিশিষ্ট।
তবে আধুনিক প্রযুক্তি কিছু "অ্যালার্ট" দিতে পারে। যেমন—
মাইক্রো-কম্পন, ভূগর্ভস্থ গ্যাস নিঃসরণ, পাথরের চৌম্বকীয় পরিবর্তন, জিপিএস মুভমেন্ট ইত্যাদি দেখে ঝুঁকি অনুমান করা যায়, কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখ-সময় বলা যায় না।
শহরের ঝুঁকি! কেন স্থাপত্য ও মাটির ধরন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে?
একই মাত্রার ভূমিকম্প এক শহরে সামান্য ক্ষতি করতে পারে, আর অন্য শহরে বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে। কারণ-
⇨ নরম মাটি কম্পনকে বাড়িয়ে দেয়।
⇨ অপরিকল্পিত ভবন দ্রুত ভেঙে পড়ে।
⇨ পুরনো ও অপরীক্ষিত স্থাপনা বিপদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
⇨ ঘনবসতি উদ্ধারকাজে বাধা সৃষ্টি করে।
এই কারণেই উন্নত দেশগুলো বিল্ডিং কোড কঠোর করে, ফাউন্ডেশন শক্তিশালী করে, আর স্থাপত্যে বিশেষ শক-অ্যাবসরবিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
সুনামির সাথে ভূমিকম্পের সংযোগ-
সমুদ্রের নীচে বড় ভূমিকম্প হলে সাগরের তলদেশ উঁচু–নিচু হয়ে যায়। এই নড়াচড়া জলকে হঠাৎ স্থানচ্যুত করে, আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় সুনামি। তরঙ্গগুলো গভীর সমুদ্রে দ্রুত ছুটে যায়, কিন্তু উপকূলে এসে ধ্বংসাত্মক ঢেউয়ে পরিণত হয়। তাই উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে দ্রুত সরে যাওয়াই সবচেয়ে কার্যকর বাঁচার উপায়।
ভূমিকম্পকে থামানো বা নিষ্ক্রিয় করা আমাদের হাতে নেই। কারণ এটি পৃথিবীর স্বাভাবিক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার অংশ, যা কোটি বছর ধরে চলছে এবং আরও কোটি বছর চলবে।কিন্তু মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর এই ক্ষমতা আমাদের আছে। সচেতনতা, প্রস্তুতি, নিরাপদ স্থাপত্য, ভূ-গবেষণা, শহর পরিকল্পনা- এসবই পার্থক্য গড়ে দেয় মৃত্যুহার, ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্গঠনের মাঝে। পৃথিবীর গভীরের নীরব চাপ হঠাৎ মুক্তি পেলে আমরা কেঁপে উঠি, ঘর দুলে ওঠে, মানুষ ছুটে বের হয়। কিন্তু এই মুহূর্তগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় এক গভীর সত্য: আমরা প্রকৃতির অতিথি মাত্র; তাকে বোঝা, সম্মান করা ও তার নিয়ম মানাই আমাদের বাঁচার মূলমন্ত্র।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।