পেঁচার চোখে কী আছে এমন? যা দেখে বিজ্ঞানীরাও ভবিষ্যৎ নাইট-ভিশন প্রযুক্তি নিয়ে নতুন ভাবনায়!

পেঁচার চোখে কী আছে এমন? যা দেখে বিজ্ঞানীরাও ভবিষ্যৎ নাইট-ভিশন প্রযুক্তি নিয়ে নতুন ভাবনায়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

রাত নামলে মানবচোখের জন্য দুনিয়া অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে যায়। আলো কমে গেলে আমরা অন্ধকারে আকার–আকৃতি আলাদা করতে পারি না, দূরের গতিবিধি চিহ্নিত করতে পারি না। অথচ ঠিক সেই সময়টিকেই নিজের সবচেয়ে সক্রিয় কর্মঘণ্টা হিসেবে বেছে নেয় এক বিস্ময়কর প্রাণী—পেঁচা। রাতের অন্ধকার তার কাছে বাধা নয়; বরং সুযোগ। রাত যত গভীর হয়, এই পাখির দৃষ্টি ততই স্পষ্ট, ততই ধারালো। মনে হতে পারে পেঁচা যেন অদ্ভুত কোনো জাদু জানে। কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে খাঁটি বিজ্ঞান, বিবর্তনের দীর্ঘ পথচলা এবং উন্নত শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য।

পেঁচার চোখের গঠন আমাদের চোখের মতো গোল নয়। এর চোখ অনেকটা নলাকার  অর্থাৎ টিউব বা সিলিন্ডারের মতো। এই বিশেষ আকৃতি ইউভ্যালুয়েশনে পেঁচাকে একটি বড় সুবিধা দিয়েছে—আলো গ্রহণ করার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। কারণ, এই নলাকার চেম্বারে লেন্স থেকে রেটিনার দূরত্ব বেশি, ফলে যেকোনো ক্ষীণ আলোও দীর্ঘ পথ পেরিয়ে রেটিনায় বেশি বিস্তৃতভাবে পড়ে।এটি অনেকটা টেলিস্কোপের নলাকার গঠনের মতো। আলোককে কেন্দ্র করে বেশি পরিমাণে রেটিনায় পৌঁছে দেয়। এই চোখ কাঠামোই পেঁচাকে অন্ধকারে দেখতে সবচেয়ে বড় অনুভূমিক ভিত্তি দেয়

 

মানুষের চোখে আলো ধরার জন্য দুই ধরনের কোষ আছে—রড ও কোন। কোন কোষ রঙ চিনতে সাহায্য করে, আর রড কোষ কম আলোতেও আকার–আকৃতি বুঝতে সাহায্য করে। মানুষের চোখে রড কোষের সংখ্যা সীমিত। অন্যদিকে পেঁচার চোখে রড কোষের ঘনত্ব মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি, এটাই রাত দেখার মূল রহস্য। রড কোষ যত বেশি, রাতের দৃষ্টি তত স্পষ্ট। রড কোষ আলোর ক্ষুদ্র কণা (ফোটন) পর্যন্ত ধারণ করতে পারে। যেখানে মানুষের চোখ ১০০ ইউনিট আলোতে দৃষ্টি পায়, পেঁচা সেখানে ২–৫ ইউনিট আলোর ক্ষুদ্রতম কণাও শনাক্ত করতে পারে। অর্থাৎ, অন্ধকার আমাদের চোখকে বিভ্রান্ত করলেও পেঁচার চোখে তখন যেন আরেকটি পৃথিবী উন্মোচিত হয়

অনেক রাত্রিজীবী প্রাণীর মতো পেঁচার চোখেও ট্যাপেটাম লুসিডাম নামে একটি বিশেষ প্রতিফলক স্তর থাকে। এটি রেটিনার ঠিক পিছনে অবস্থিত একটি প্রতিফলক পর্দা, যা রেটিনায় পৌঁছানো আলো একবার ব্যবহারের পর আবার প্রতিফলিত করে দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সুযোগ দেয়। মানুষের চোখ এই ক্ষমতা রাখে না। ফলে পেঁচা একক আলোক কণাকেও দুইবার ব্যবহার করে। এ যেন অন্ধকারে দ্বিগুণ আলো ঘনীভূত করার ক্ষমতা!

 

পেঁচার চোখ বড় এবং খুলির ভেতরে শক্তভাবে স্থির থাকে। আমাদের মতো চোখ বাম–ডান, উপরে–নিচে ঘুরে না। সমস্যা হলো চোখ না ঘোরালে তো চারপাশ দেখা কঠিন! তবে  প্রকৃতি দিয়েছে চমৎকার এক বিকল্প, পেঁচা তার মাথা ২৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরাতে পারে। এটি অন্ধকারে নিখুঁতভাবে চারপাশ পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা দেয়। যেন চোখ স্থির থেকে মাথাই ঘুরছে ক্যামেরার গিম্বালের মতো।

অনেক পাখির চোখ মাথার দুই পাশে থাকে, ফলে তাদের দৃষ্টিক্ষেত্র বেশি হলেও গভীরতা বোঝার ক্ষমতা কম।কিন্তু পেঁচার চোখ মানুষের মতো সামনের দিকে অবস্থিত। ফলে দুই চোখের দৃষ্টিক্ষেত্র ওভারল্যাপ হয়ে তৈরি হয় বাইনোকুলার ভিশন। ফলে গভীরতা (Depth perception) সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায়। এই ক্ষমতা রাতের শিকার ধরতে অপরিহার্য। দূরত্ব ভুল হলে শিকার মুহূর্তেই পালিয়ে যেতে পারে।

দৃষ্টিশক্তি এক ধরনের সেন্সরি ইনপুট। কিন্তু পেঁচা শুধু দৃষ্টি দিয়েই রাত জয় করে না, তার নীরব উড়ালও দৃষ্টিশক্তিকে বাড়তি সুবিধা দেয়।
 

কেন নীরব উড়াল গুরুত্বপূর্ণ?

শব্দ না হওয়ায় তার নিজস্ব শ্রবণশক্তি বিঘ্নিত হয় না। সামান্য প্রতিধ্বনি বা পাতার খসখস শব্দ থেকেও শিকার শনাক্ত করা যায়। রাতের বাতাসে শব্দহীন চলাচল দৃষ্টিশক্তির সাথে মিলিত হয়ে পরিপূর্ণ  শিকার সনাক্তকরণ সিস্টেম তৈরি করে। নীরব উড়াল আসলে পেঁচার চোখের দক্ষতার ওপর চাপ কমায়, যা তাকে আরও নিখুঁতভাবে পরিবেশ বিশ্লেষণে সাহায্য করে।

পেঁচার চোখে কর্নিয়া (চোখের স্বচ্ছ বাহিরের স্তর) মানুষের তুলনায় বড়। কর্নিয়া যত বড়,আলো গ্রহণ তত বেশি হয়, রেটিনায় আলোর তীব্রতা তত শক্তিশালী হয়। অন্ধকার পরিবেশও তত বেশি আলোকিত মনে হয়। অল্প আলোতে কাজ করার এই অবিশ্বাস্য দক্ষতায় পেঁচা যেন নিজের চোখেই নাইট ভিশন গগলস পরে থাকে।

 

কিছু  কোষ কম থাকার কারণে পেঁচা মানুষের মতো রঙ স্পষ্টভাবে দেখে না। কিন্তু বিবর্তন তাকে দিয়েছে রঙহীন অন্ধকারে নিখুঁত দৃষ্টিশক্তি। এক কথায় বলতে গেলে, রঙ নয়; আলো–ছায়া ও চলাচলই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। রাতের শিকার ধরতে রঙের প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণে পেঁচার চোখ উজ্জ্বলতা–সংবেদী বা light-sensitive vision এ অত্যন্ত শক্তিশালী।

 

আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা হলো-পেঁচা শুধু চোখের ওপর নির্ভর করে। বাস্তবে, পেঁচার মস্তিষ্ক তার দৃষ্টি তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে অত্যন্ত দক্ষ। চোখ থেকে আসা ভিজ্যুয়াল ডেটা খুব দ্রুত বিশ্লেষণ হয়। আলো কম হলেও গতির ক্ষুদ্রতম পরিবর্তন ধরে ফেলে। শব্দ ও দৃষ্টিকে একসাথে মিলিয়ে শিকার সনাক্ত করে। এটি মানুষের চেয়েও দ্রুত কাজ করে। অতএব, পেঁচা শুধু "ভালো দেখে" নয়-"বুদ্ধিমত্তার সাথে দেখে"। রাতে সম্পূর্ণ দৃষ্টিভরসায় কাজ করলে ভুল হওয়ার সুযোগ থাকতে পারে।তাই পেঁচা তার শ্রবণশক্তিকেও সমান শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে।
 

পেঁচা কি অন্ধকারেও দিনের মতোই সব দেখে?

এটি একটি সাধারণ ভুল ধারণা। পেঁচা দিনের মতো রঙিন ছবি দেখে না; বরং উচ্চ কনট্রাস্টযুক্ত স্পষ্ট মনোক্রোমেটিক দৃশ্য দেখে, যা তার কাছে একইভাবে কার্যকর। অর্থাৎ, আমাদের চোখে অন্ধকার হলেও পেঁচার চোখে সেই পরিবেশ এমনভাবে আলো–ছায়ায় দেখা যায়, যা শিকারের গতিবিধি বুঝতে নিখুঁত।
 

রাতের দৃষ্টি নিয়ে গবেষণায় পেঁচার চোখ বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্র। পেঁচার চোখের রড সেলের অতিমাত্রিক ঘনত্ব,আলো প্রতিফলন ব্যবস্থাপনা, টিউবুলার শেপ, পরিবেশ–সংবেদী দৃষ্টি সবই আধুনিক নাইট ভিশন প্রযুক্তির অনুকরণীয় উদাহরণ। রাতের ক্যামেরা, থার্মাল সেন্সর, স্মার্ট বাইনারি লাইট ক্যাপচারিং সিস্টেম—সবখানেই পেঁচার চোখ প্রকৃতির এক শিক্ষা।

রাত মানুষের জন্য সবসময়ই কিছুটা রহস্যময়। আলোর অভাব আমাদের ইন্দ্রিয়কে দুর্বল করে দেয়, আমাদের সীমাবদ্ধ করে। কিন্তু প্রকৃতি পেঁচাকে তৈরি করেছে ঠিক উল্টোভাবে। অন্ধকারে সে সবচেয়ে শক্তিশালী, সক্রিয়, এবং সক্ষম। আমরা যেখানে অন্ধকারে ভয় পাই, থমকে যাই, সেখানে পেঁচা যেন অদৃশ্য চোখে পুরো পৃথিবীটাকে দেখে চলে। তার চোখ প্রকৃতির এমন এক শিল্পকর্ম, যা অন্ধকারকে আলোয় রূপান্তর করতে জানে। এটাই তাকে রাতের নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ শিকারি বানিয়েছে। রাতের আকাশে পেঁচার উড়ে যাওয়া তাই শুধু নীরবতা নয়। এ এক অদেখা বিশ্বকে দেখার ক্ষমতা, যা আমাদের চোখ পারে না; কিন্তু তার চোখ পারে সহজেই।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ