ঘরের কোণে সবুজের গবেষণাগার! হাইড্রোপনিক হার্বস যেভাবে বদলে দিচ্ছে শহুরে বাগানচর্চা

ঘরের কোণে সবুজের গবেষণাগার! হাইড্রোপনিক হার্বস যেভাবে বদলে দিচ্ছে শহুরে বাগানচর্চা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শহরের ব্যস্ততা, কংক্রিটের ঘেরাটোপ আর সীমিত জায়গার মধ্যে বাগান করা যেন অনেকের স্বপ্নই রয়ে যায়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি সেই স্বপ্নের রং বদলে দিচ্ছে। ঘরের ভেতরই এখন জন্মাচ্ছে তুলসি, পুদিনা, বাসিল, সিলান্ট্রো, থাইম, অরেগানোসহ নানা হার্বস সবই মাটিবিহীন, পরিচ্ছন্ন, দ্রুত বৃদ্ধি ও নিয়মিত উৎপাদনের মাধ্যমে। এই পদ্ধতির নাম হাইড্রোপনিক্স, যেখানে গাছ মাটির বদলে পানি ও পুষ্টির সমন্বিত দ্রবণের ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে।

শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে গবেষকরা জানেন, গাছের বৃদ্ধি আসলে মাটির কারণে নয় বরং মাটিতে থাকা খনিজ উপাদান, পানি ও অক্সিজেনের কারণে। মাটির ভূমিকা কেবল একটি ধারণস্থল। অর্থাৎ, গাছকে ধরে রাখা, পানি ধরে রাখা, আর কিছু পুষ্টি সরবরাহ। হাইড্রোপনিক্সে এই ধারণস্থলটি পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। গাছের শিকড় সরাসরি পুষ্টি দ্রবণের সংস্পর্শে আসে, যেখানে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, ট্রেস মিনারেল সবই সঠিক পরিমাণে থাকে। এভাবে গাছের শিকড় মাটির প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পুষ্টি গ্রহণ করে, ফলে বৃদ্ধি হয় দ্রুত ও সুস্থভাবে।
 

কেন হাইড্রোপনিক হার্বস শহুরে জীবনে বিপ্লব আনছে!

১. কম জায়গায় বেশি ফলন। একটি জানালার কোনা, রান্নাঘরের টেবিল কিংবা ডেস্কের পাশে ছোট একটি র‍্যাকই হাইড্রোপনিক হার্বসের জন্য যথেষ্ট। মাটি না থাকায় জায়গার সাশ্রয় হয়।

২. পানির অপচয় খুব কম। হাইড্রোপনিক সিস্টেমে পানির পুনর্ব্যবহার হয়। সাধারণ মাটির বাগানে প্রতি সপ্তাহে যে পানি লাগত, এখানে তার তুলনায় প্রয়োজন হয় অল্প অংশ।

৩. বাগানের ঝামেলা নেই। মাটি কেনা, পোকামাকড়, আগাছা, কাদামাটি কিছুই নেই। ঘরের ভেতর কাজ হওয়ায় পরিবেশ থাকে পরিচ্ছন্ন।

৪. দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মাটির তুলনায় গাছ ৩০–৫০% দ্রুত বাড়ে।কারণ, শিকড় সরাসরি পুষ্টি পায়।

৫. শীত, গরম, বর্ষা—ঘরের ভেতর আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সারাবছর উৎপাদন সম্ভব।

৬. পেস্টিসাইড ছাড়াই স্বাস্থ্যকর উৎপাদন!

মাটিবিহীন বলে বেশিরভাগ ইনডোর হাইড্রোপনিক হার্বসে রাসায়নিক কীটনাশক লাগে না।

 

এগুলোই শহুরে মানুষকে হাইড্রোপনিক্সের দিকে দ্রুত আকৃষ্ট করছে।

 

ঘরের ভেতর হাইড্রোপনিক হার্বস চাষ প্রক্রিয়া  —

নিচের ধাপগুলো ঘরের ভিতর সফলভাবে হাইড্রোপনিক হার্বস চাষের সবচেয়ে সহজ, কার্যকর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে মানা হয়।

➤ প্রথমেই সঠিক পদ্ধতি বেছে নিন। ইন্ডোর হাইড্রোপনিক্সে দুটি জনপ্রিয় পদ্ধতি—

(ক) Kratky Method (বিনা মেশিনে, সবচেয়ে সহজ)। কোনো মোটর, পাম্প বা ইলেকট্রিসিটি প্রয়োজন হয় না।একটি বালতিতে পানি ও পুষ্টি রেখে তার ওপর নেট পট বসানো হয়। শিকড় পানি থেকে পুষ্টি টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ে। এই পদ্ধতি বিশেষ করে পুদিনা, বাসিল, ধনিয়া ইত্যাদিতে দারুণ কাজ করে।

 

(খ) Deep Water Culture (DWC): শিকড় সবসময় পানিতে থাকে। ছোট একটি এয়ার পাম্প দিয়ে পানির মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া হার্বসের জন্য এটি কার্যকর।
নবীনদের জন্য Kratky সবচেয়ে সহজ।
 

➤ তারপর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করুন।সব কিছু সহজে পাওয়া যায়, অনেকসময় ঘরেই পাওয়া যায়। নেট পট (ছিদ্রযুক্ত ছোট কাপ),পুষ্টি দ্রবণ (Hydroponic Nutrients), পানি ধরে রাখার পাত্র, আলো আসা জায়গা / LED Grow Light, Coco cube বা Rockwool–চারা ধরে রাখার মাধ্যম pH মাপার স্ট্রিপ (ঐচ্ছিক কিন্তু উপকারী)
 

➤ পানির গুণাগুণ ঠিক করুন। হাইড্রোপনিক্সে পানি হচ্ছে মাটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ফল পেতে pH 5.5 থেকে 6.5 এর মধ্যে রাখা আদর্শ।খুব বেশি খনিজযুক্ত পানি হলে শিকড় পুষ্টি শোষণ করতে পারে না। পরিষ্কার, দুর্গন্ধহীন পানি ব্যবহারে গাছ দ্রুত খাপ খায়।
 

➤ বীজ অঙ্কুর তৈরি করা। বীজ সরাসরি পানিতে দিলে শিকড় গলে যায়। তাই Rockwool বা Coco cube ব্যবহার করুন।

১. Cube হালকা ভিজিয়ে নিন

২. বীজ বসান

৩. আলো-আলোর কাছে রাখুন

৪. ৩–১০ দিনের মধ্যে চারা বের হয়

যেই চারা ২টি আসল পাতা ছড়িয়ে দেয়, তখন হাইড্রোপনিক সিস্টেমে স্থানান্তর করার সময়।
 

➤ আলো হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হার্বস ঘরের ভেতরে বাড়তে হলে যথেষ্ট আলো দরকার। প্রকৃতির আলো যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার গুণগত তীব্রতা, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন 10–14 ঘণ্টা আলো ভালো ফল দেয়। জানালার পাশে রাখলে ভালো, কিন্তু সরাসরি তীব্র রোদ না লাগাই ভালো। LED Grow Light থাকলে আরও সহজ হয়ে যায়। আলোর অভাবে গাছ পাতলা, দুর্বল ও লম্বা হয়ে যায়। একেই বলা হয় “Leggy Growth”।
 

➤ পুষ্টি যোগ করার নিয়ম। হার্বস পুষ্টি গ্রহণে খুবই সংবেদনশীল। অতিরিক্ত পুষ্টি দিলে শিকড় পুড়ে যায়, আর কম হলে গাছ বিবর্ণ হয়ে পড়ে। সঠিক নিয়ম-

⇨ প্রথম সপ্তাহে অল্প ঘনত্ব

⇨ ২ সপ্তাহ পর মাঝারি

⇨ শিকড় বাড়লে পূর্ণ ঘনত্ব
 

রঙ ফ্যাকাশে হলে বুঝবেন নাইট্রোজেন কম। পাতা ঝিমঝিম হলে বুঝবেন পটাশিয়াম কম। কিন্তু পুষ্টি বাড়ানোর আগে সবসময় পানি ও আলো পরীক্ষা করুন। এ দুটির ভারসাম্য নষ্ট হলে গাছ ভেঙে পড়ে।
 

➤  শিকড়ের স্বাস্থ্য দেখুন! স্বাস্থ্যবান হাইড্রোপনিক শিকড় সাদা, টানটান, মসৃণ। যদি শিকড় বাদামী হয়ে যায়, গন্ধ বের হয় বা নরম লাগে তাহলে পানি দ্রুত বদলাতে হবে। বেশি তাপমাত্রা বা কম অক্সিজেন শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত করে।
 

➤ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ!

হাইড্রোপনিক হার্বস মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে-

১. আলো

২. পানি

৩. পুষ্টি

এগুলোর যেকোনো একটিতে ভুল হলে গাছ দ্রুত সংকেত দেয়। পাতার রঙ, চারা বৃদ্ধির গতি, শিকড়ে সাদা লোম দেখা—সব কিছুই নজরে রাখা উচিত।

 

ঘরের ভেতর হাইড্রোপনিক্সে সহজে জন্মে এমন হার্বস-

১. পুদিনা, সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে। শিকড় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হার্বসের রাণী বলা হয়।

২. তুলসি/বাসিল, অত্যন্ত সুগন্ধি হার্ব। আলো বেশি দরকার হলেও পানির প্রতি খুব অনুগত।

৩. ধনিয়া (Cilantro), শীতল পরিবেশ পছন্দ করে। Kratky পদ্ধতিতে ভালো জন্মায়।

৪. অরেগানো, ধীর গতির হার্ব, কিন্তু একবার বেড়ে গেলে সারাবছর সরবরাহ দেয়।

৫. থাইম ও রোজমেরি, হালকা আর্দ্রতা পছন্দ করে। আলো বেশি দিলে গন্ধ বাড়ে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, হাইড্রোপনিক হার্বস এ ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফেনোলিক যৌগ

এসেনশিয়াল অয়েল- মাটির গাছের তুলনায় বেশি ধারণ করতে পারে। কারণ গাছ যখন পানির অভাব, মাটির প্রতিবন্ধকতা বা কীটপতঙ্গের চাপ ছাড়া বাড়ে, তখন তার শক্তি সরাসরি পুষ্টি ও স্বাদের দিকে কাজে লাগে।
 

ঘরের ভেতর হাইড্রোপনিক্স শুরু করতে কতটুকু খরচ?

এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে-

⇨ নিজের তৈরি সেটআপ

⇨.নেট পটের সংখ্যা

⇨ আলো আছে কিনা

 

হাইড্রোপনিক্সে কোন ভুলগুলো করলে গাছ নষ্ট হয়!

১. অতিরিক্ত পানি বা গরম পানি ব্যবহার। শিকড়ে অক্সিজেন কমে যায়।

২. আলো কম দেওয়া। পুষ্টি ঠিক থাকলেও আলো না থাকলে গাছ বাড়বে না।

৩. Too much nutrients। অতিরিক্ত পুষ্টিতে শিকড় পোড়ে-পাতা হলুদ হয়।

৪. পানি বদল না করা। পানিতে ব্যাকটেরিয়া জমলে শিকড় নরম হয়ে নষ্ট হয়।

৫. রুমের তাপমাত্রা ৩০°C এর বেশি হওয়া। এই তাপে শিকড়ের কার্যক্ষমতা কমে যায়।

 

এক কাপ লেবুর চায়ে বাসিলের তাজা পাতা ফেলে দিলেন। রান্নাঘরে পাস্তা বানাতে গিয়ে পাশেই থাকা হাইড্রোপনিক পুদিনা থেকে কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে নিলেন। জানালার ধারে সবুজ আলো জ্বলে আছে, আর তার মাঝখানে সারি সারি ছোট গাছ; দিনের পর দিন বাড়ছে, কেটে নিলেও আবার নতুন শাখা গজাচ্ছে।শহরের ব্যস্ত মানুষ যখন মাটিতে বাগান করতে পারে না, হাইড্রোপনিক্স তখন ছোট্ট জায়গায় একটি জীবন্ত, সতেজ সবুজ ভুবন তৈরি করে।

হাইড্রোপনিক হার্বস শুধু বাগান করার একটি নতুন ট্রেন্ড নয়, এটি একটি বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতি, যা শহুরে মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ঘরের ভেতর নিজস্ব একটি সবুজ ইকোসিস্টেম তৈরি করে। কম জায়গা, কম পানি, কম ঝামেলা, কিন্তু বেশি ফলন এটাই হাইড্রোপনিক্সকে আগামী দিনের শহুরে কৃষির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। ঘরের ছোট্ট কোণে দাঁড়িয়েও যে কেউ এখন নিজের স্বাস্থ্যকর, সুগন্ধি, পুষ্টিগুণে ভরপুর হার্বস উৎপাদন করতে পারে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ