আমেরিকাবিরোধী জোটের ভিত্তি রচনায় ট্রাম্পের ভূমিকা!

আমেরিকাবিরোধী জোটের ভিত্তি রচনায় ট্রাম্পের ভূমিকা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

“আগে গুলি চালাও, তারপর প্রশ্ন করো—এটাই আমাদের শুল্ক বিষয়ক কৌশল।” গত বছরের শেষদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আমাকে এই কথাটি বলেছিলেন।

এই ধরনের গর্বময় ভাষণ এখন ওয়াশিংটনে হালফ্যাশন হয়ে উঠেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিন্তাভাবনা ছাড়াই এভাবে চাঁদা-ছোলা কথা বলার কৌশলটি খুবই বিপজ্জনক। এটি না শুধু আমেরিকার জন্য, বরং সেইসব দেশের জন্যও বিপজ্জনক যাদের উপর ট্রাম্প বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দুটি বড় ঝুঁকি আসতে পারে: উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি এবং শিল্প খাতে বিপর্যয়। এই দুটি ঝুঁকি সবারই জানা।

এটা ঠিক যে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো গুরুতর পরিণতি আমেরিকাকে বহন করতে হবে না। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতি পশ্চিমা বিশ্বের একতা ও মৈত্রীকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশ আমেরিকার কাছ থেকে নতুন হুমকি অনুভব করছে এবং একটি বিকল্প জোট গঠনের দিকে ঝুঁকছে। আর ট্রাম্প সেই বীজই বুনছেন।

যদি পশ্চিমা বিশ্বের একতা ধ্বংস হয়, তাহলে তা হবে চীন ও রাশিয়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ট্রাম্প হয়তো এটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তেমন চিন্তিত নন। তিনি প্রায়ই ভ্লাদিমির পুতিন এবং সি চিনপিং-এর প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি যাদেরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন, যেমন মারকো রুবিও এবং মাইক ওয়ালৎজ, তারা বিশ্বাস করেন যে চীনের শক্তিমত্তাকে প্রশমিত করাই হলো যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।

যদি তা-ই হয়, তাহলে চীন, কানাডা এবং মেক্সিকোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা ট্রাম্পের জন্য পুরোপুরি একটি বোকামি। কারণ এর মাধ্যমে তিনি এই তিন দেশের স্বার্থকে একত্রিত করে দিচ্ছেন। এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)ও জড়িত, যারা ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য।

২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন ইইউ চীনের সঙ্গে নতুন একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু ওয়াশিংটনের চাপ এবং বেইজিংয়ের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ব্রাসেলসকে পিছিয়ে আসতে হয়। তবে বাইডেন প্রশাসনের শেষভাগে আসার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কমিশন একত্রে কাজ করছিল চীনের সঙ্গে বাণিজ্যকে ‘ঝুঁকিমুক্ত’ করার জন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি রপ্তানি আটকে দেওয়ার জন্য।

বাইডেন প্রশাসনের যুক্তি ছিল যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে সে তখনই টিকে থাকবে যখন অন্যান্য অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে তার পাশে নিয়ে কাজ করতে পারে। এর বিপরীতে ট্রাম্প আমেরিকার মিত্রদের চেয়ে প্রতিপক্ষদের দিকে বেশি চড়াও হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে যে তিনি মিত্রদের চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকরা এটা ভালোভাবেই জানেন যে, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি, ব্যাটারি এবং সৌর প্যানেল ছাড়া তা অসম্ভব। আর আমেরিকার বাজার হারানোর হুমকি চীনের বাজারকে আরও বেশি প্রয়োজনীয় করে তুলবে। আমি যখন গত সপ্তাহে একজন ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় নীতিনির্ধারককে বলেছিলাম যে ইইউ এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার কথা ভাবতে পারে, তখন তার উত্তর ছিল, “বিশ্বাস করুন বা না করুন, এই আলোচনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।”

এমনকি কিছু প্রভাবশালী ইউরোপীয় এখন এই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে কে বেশি হুমকি? দুই মাস আগে এমন প্রশ্ন অবান্তর ছিল। কিন্তু সি নয়; বরং ট্রাম্পই কানাডার স্বাধীনতার সমাপ্তি ঘটানোর কথা বলছেন। অথচ কানাডা হলো ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। আবার চীন সরকার নয়; বরং ট্রাম্প প্রশাসন এবং ইলন মাস্ক ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন জোগাচ্ছেন।

চীনের বেনিয়াবাদ এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ যুদ্ধের জন্য বেইজিংয়ের সমর্থন এখনো ব্রাসেলস এবং চীনের মধ্যে যেকোনো সুসম্পর্ক স্থাপনের পথে প্রধান বাধা। কিন্তু যদি ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করে এবং বেইজিং রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হয়, তাহলে ইউরোপীয়রা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।

লাতিন আমেরিকাতেও চীন নতুন সুযোগ খুঁজতে যাবে। কারণ পানামা এবং মেক্সিকোর প্রতি আমেরিকার হুমকি ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আসন্ন। ট্রাম্প যেহেতু পানামা খালের ওপর পুনর্নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এবং মেক্সিকোর মাদক চক্রকে দেখে নিতে চান, তাই এই দুই দেশের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ সহ যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পদক্ষেপ আসন্ন।

কিন্তু মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের আগ্রাসন হিতে বিপরীত ফল হতে পারে। উচ্চহারে আরোপিত শুল্কের কারণে দেশটিতে যদি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য মরিয়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে মাদকচক্রের দৌরাত্ম্য, যা চোরাই পথে রপ্তানি হবে।

কানাডা এবং মেক্সিকো যন্ত্রণাবিদ্ধভাবে জানে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে বাজি তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের পাল্টা আঘাত করতেই হবে। আমেরিকার বলপ্রয়োগের মুখে কোনো জাতীয় নেতাই নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। এবং ট্রাম্পকে পাল্টা আঘাত করাই সম্ভবত সঠিক কৌশল। সম্প্রতি একজন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, “ট্রাম্প যদি আপনার মুখে ঘুষি মারে এবং আপনি পাল্টা না মারেন, তাহলে তিনি আবারও আপনাকে আঘাত করবেন।”

এখন পর্যন্ত ব্রিটেন এবং জাপান ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়নি। এটা তাদের জন্য সাময়িক স্বস্তি বটে। কিন্তু তারা যদি ভাবে যে চুপচাপ থাকলে বেঁচে যাবে, তাহলে তা হবে নিজেদের ছেলে ভোলানো বুঝ দেওয়া। ট্রাম্প যদি মনে করেন যে প্রথম দফার শুল্কযুদ্ধ কাজে দিয়েছে, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি আরও নতুন লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করবেন আক্রমণ চালানোর জন্য।

কর্পোরেট আমেরিকারও এখন সজাগ হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ‘অ্যানিমেল স্পিরিটস’ ফিরে আসার জল্পনায় পিঠ চাপড়ানো বন্ধ করা উচিত। ট্রাম্প আসলে আমেরিকাকে যা দিতে চাইছেন, তা হলো কথিত অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং পশ্চিমা মিত্রতার ধ্বংস। আর তা আমেরিকার ব্যবসায়ীদের জন্য এক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে, যেখানে গোটা আমেরিকাও নিমজ্জিত হবে।


সম্পর্কিত নিউজ