রাষ্ট্রপতির ক্ষমা

ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার নয়, ন্যায়বিচারের প্রতীক হোক

ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার নয়, ন্যায়বিচারের প্রতীক হোক
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

গত বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনে বিচার বিভাগের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমার এখতিয়ার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ।

সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের দেওয়া দণ্ড মার্জনা, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন বিধান থাকলেও বাংলাদেশে এই ক্ষমতার অপব্যবহার চোখে পড়ার মতো। অতীতের বিভিন্ন সরকার রাষ্ট্রপতির ক্ষমাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে দণ্ডিত অপরাধীদের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। এটি কেবল আইনের শাসনের জন্য হুমকিই নয়, ন্যায়বিচারের মূলনীতিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিধানটি মূলত বিশেষ পরিস্থিতিতে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাবনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে রাষ্ট্রপতি কেবল আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষরদাতায় পরিণত হন। অনেক ক্ষেত্রে যাদের দণ্ড মওকুফ করা হয়, রাষ্ট্রপতি তাদের চেনেনও না।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এই অপব্যবহার রোধে একটি নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করেছে। এই বোর্ড রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন পর্যালোচনা করবে এবং আবেদনকারী ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য কি না, তা নির্ধারণ করবে। রাষ্ট্রপতি এই বোর্ডের সুপারিশ ছাড়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।

এ বিষয়ে গত ২০ জানুয়ারি হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিটের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই রিটে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রক্রিয়ায় একটি স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। আবেদনকারী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাশান প্রথম আলোকে বলেন, "রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার সংবিধানের ৭, ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ জন্য এই ক্ষমতা প্রয়োগে একটি নীতিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য।"

হাইকোর্টের রিট ও বিচার সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার রোধে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠিত হলেও তাদের কাজ করতে হবে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে।

এই প্রেক্ষাপটে, আমরা মনে করি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমার সুযোগ নিয়ে যেন কোনো সরকারই দণ্ডিত অপরাধীদের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।


সম্পর্কিত নিউজ