জ্ঞান এখন পর্দায়, বইতে নয়?-২১ শতকের পাঠ্যবই নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কে নতুন মোড়!

জ্ঞান এখন পর্দায়, বইতে নয়?-২১ শতকের পাঠ্যবই নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কে নতুন মোড়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একটা সময় ছিল, যখন পাঠ্যবই মানেই ছিল নিয়মিত সিলেবাস, নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা, আর পরীক্ষার আগে মুখস্থ করার যুদ্ধ। সকালের আলোয় বইয়ের পাতা খুললেই মনে হতো, যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে একগাদা তথ্য, যেগুলো মনে রাখা ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু সময় পাল্টেছে। আজকের পৃথিবী বদলে গেছে এমনভাবে, যেখানে শেখা মানে কেবল জানা নয়, বরং বোঝা , চিন্তা করা আর প্রয়োগ করতে পারা। এই বাস্তবতায় শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২১ শতকের পাঠ্যবইকে আর পুরোনো ধাঁচে রাখা যাবে না। এখন বই হতে হবে এমন, যা পাঠককে প্রশ্ন করতে শেখাবে, ভাবতে শেখাবে, আর শেখাকে জীবনের সঙ্গে মেলাতে শেখাবে।

আজকের শিশুরা এমন এক যুগে বড় হচ্ছে, যেখানে গুগল বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদের সামনে অসীম তথ্যের দরজা খুলে দিয়েছে। তারা জানে, একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে এখন আর মোটা বই উল্টাতে হয় না। তাদের প্রয়োজন, কোন তথ্যটা সত্য, কোনটা ভুয়া, আর কোনটা অর্থবহ, সেটা বুঝতে শেখা। এই কারণেই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবইকে শুধু জ্ঞানের উৎস হিসেবে দেখা বন্ধ হয়েছে; এখন সেটাকে দেখা হচ্ছে চিন্তার অনুঘটক হিসেবে। ফিনল্যান্ড বা জাপানের স্কুলগুলোতে এখন আর আলাদা আলাদা বই পড়ে না, তারা পড়ছে প্রকল্পনির্ভর পাঠ্য, যেখানে ইতিহাস শেখা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, কিংবা গণিত শেখা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধান করতে করতে। এভাবেই তারা শেখে, বই মানে শুধু পাঠ নয়, এটা জীবনের প্রতিফলন।

২১ শতকের পাঠ্যবই এখন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ডিজিটাল সহচর-এ। তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে দিয়েছে নতুন চেহারা। শিক্ষার্থীরা এখন ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরিতে বসে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা করছে, ইতিহাস শিখছে অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে ঘুরে বেড়িয়ে, এমনকি ভাষা শিখছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় উচ্চারণ অনুশীলনের মাধ্যমে। তারা শিখছে খেলার ছলে, অনুশীলনের ভেতর দিয়ে। এ যেন বই আর ক্লাসরুমের সীমানা ভেঙে গিয়ে শেখাকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনন্ত জগতে। একজন ফিনিশ শিক্ষক একবার বলেছিলেন, "শিক্ষার্থীরা বই পড়ে না, তারা বইয়ের মধ্যে বাস করে।" এই বাক্যটা এখন বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থার মূল দর্শন হয়ে উঠেছে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পেশাগত সাফল্য নয়; বরং মানুষ হয়ে ওঠা। আর সেই মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই পাঠ্যবইয়ের নতুন দায়িত্ব। এই বই এখন শেখায় সহমর্মিতা, শেখায় সমাজ ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা। যে শিশু অন্যের দুঃখ বুঝতে শেখে, সে-ই ভবিষ্যতের দায়িত্ববান নাগরিক হতে পারে। তাই অনেক দেশের পাঠ্যবইয়ে এখন গল্পের আকারে যুক্ত হচ্ছে পরিবেশ, মানবাধিকার, বৈচিত্র্য, এবং নৈতিকতার বিষয়গুলো। শিক্ষার্থীরা জানছে, পৃথিবী শুধু নিজের নয়, এটা আমাদের সবার।

২১ শতকের পাঠ্যবই তাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে মানুষের মনের আয়না। এখানে শেখা মানে মুখস্থ করা নয়, বরং প্রশ্ন করা। একটি গল্প পড়লে শিশুটি ভাবছে, "আমি হলে কী করতাম?" একটি বিজ্ঞান পাঠে শেখা তথ্য নিয়ে সে নিজের ছোট্ট পরীক্ষা করছে ঘরে বসেই। আর একটি সমাজবিজ্ঞানের অধ্যায় পড়তে পড়তে সে ভাবছে, তার নিজের সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য সে কী করতে পারে। এইভাবেই শিক্ষা আর বই একসঙ্গে তৈরি করছে চিন্তাশীল প্রজন্ম।


কিন্তু পরিবর্তনটা শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় নয়, মানসিকতার ভেতরেও ঘটছে। এখন শিক্ষকও কেবল তথ্যদাতা নন, তিনি এক পথপ্রদর্শক। বইয়ের ভেতর যা নেই, সেই দিকটাও তিনি শিক্ষার্থীকে খুঁজে দেখতে শেখাচ্ছেন। শিক্ষক আর শিক্ষার্থী, দুজন মিলে শেখার এক যৌথ যাত্রায় নেমেছে। যেখানে ভুল করাও শেখার অংশ, আর কৌতূহলই হচ্ছে মূল চালিকা শক্তি।

বলা হয়, শিক্ষা যদি চিন্তা না জাগায়, তবে তা কেবল স্মৃতির ভার। এই কারণেই আধুনিক পাঠ্যবই তথ্যের পরিমাণ কমিয়ে এনে যুক্ত করছে অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ ও অনুভব। এখানে শেখা মানে শুধু জানার নয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়ারও এক যাত্রা। একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা তাই নতুন দিগন্তে দাঁড়িয়ে। এখন স্কুল মানে শুধু ভবন নয়, শেখার এক জীবন্ত প্রক্রিয়া। আর পাঠ্যবই সেই প্রক্রিয়ার প্রাণ, যে বই শিশুকে শিখায় কীভাবে মানুষ হওয়া যায়, কীভাবে প্রশ্ন করা যায়, আর কীভাবে উত্তর খোঁজার আনন্দে বাঁচা যায়! 

২১ শতকের পাঠ্যবই হবে এমন এক দর্পণ, যেখানে দেখা যাবে ভবিষ্যতের মানুষ-যে জানে, শেখা মানে নিজের ভেতরের আলোকে জ্বালানো। তথ্য নয়, চিন্তাই হবে তার আসল পাঠ। আর সেই পাঠই গড়ে তুলবে আগামী পৃথিবী, যেখানে শেখা থামে না কখনও।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ