"Coco (2017) ": পরিবারের বন্ধনে জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পাওয়ার এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
রঙ, সঙ্গীত, এবং স্মৃতির মিশেলে তৈরি "Coco" (2017) একটি এমন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র, যা হৃদয়ের গভীরে ছোঁয়া দেয়। এটি কেবল একটি বিনোদনমূলক ছবি নয়, বরং এক মানবিক বার্তা, যা শেখায়, জীবনের আসল সৌন্দর্য পরিবার, স্মৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে। ডিজনি ও পিক্সারের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই সিনেমা একসাথে শিল্প, বিজ্ঞান ও আবেগের নিখুঁত মেলবন্ধন।
মেক্সিকোর ছোট্ট শহর সান্তা সিসিলিয়ায় বাস করে ১২ বছরের এক ছেলে, মিগুয়েল রিভেরা। তার স্বপ্ন একজন মহান সংগীতশিল্পী হওয়ার। কিন্তু তার পরিবারে সঙ্গীতের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এর পেছনে আছে এক পুরোনো গল্প- মিগুয়েলের প্রপিতামহ একদিন সঙ্গীতের টানে পরিবার ছেড়ে চলে যান, আর সেই আঘাত থেকে জন্ম নেয় এই পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু মিগুয়েলের অন্তরে বাজে গিটার, ছন্দ ও সুরের আকুলতা। একদিন স্থানীয় সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে সে চুরি করে নেয় তার প্রিয় সংগীত নায়ক এরনেস্তো দে লা ক্রুজ–এর গিটার। কিন্তু গিটার বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে অদ্ভুত এক ঘটনা, মিগুয়েল প্রবেশ করে "Land of the Dead", অর্থাৎ মৃতদের জগতে। সেখানে সে দেখে, তার পূর্বপুরুষরা এখনো বেঁচে আছেন স্মৃতিতে, ছবিতে ও ভালোবাসায়। এই ভৌতিক অথচ সুন্দর জগতে মিগুয়েল বুঝতে শেখে- পরিবারের সঙ্গে বন্ধন কখনো ভাঙে না, এমনকি মৃত্যুর পরও না।
'Coco'-র কেন্দ্রবিন্দু হলো সঙ্গীত। গান "Remember Me" শুধু একটি সুর নয়, এটি আবেগ, স্মৃতি, এবং অস্তিত্বের প্রতীক। মিগুয়েল তার প্রপিতামহের গান "Remember Me" গেয়ে দিদিমা কো'কোকে স্মরণ করায়, আর সেই গানের মাধ্যমে জীবিত ও মৃত দুই জগতের দূরত্ব ঘুচে যায়।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি এক প্রকার "মেমোরি রিকল থেরাপি"- যেখানে সংগীত ও স্মৃতি একত্রে কাজ করে মস্তিষ্কের আবেগীয় কেন্দ্রকে সক্রিয় করে।অর্থাৎ, গানটি শুধুমাত্র একটি মেলোডি নয়, এটি জীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মানসিক সেতু।
'Coco' তৈরি হয়েছে মেক্সিকোর বিখ্যাত উৎসব Día de los Muertos (Day of the Dead)–কে কেন্দ্র করে।এই উৎসবে মানুষ তাদের মৃত প্রিয়জনদের স্মরণ করে ফুল, আলো ও প্রিয় খাবার দিয়ে।বিজ্ঞান বলে, এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুশীলন emotional healing process–এর অংশ, যেখানে প্রিয়জনকে স্মরণ করার মাধ্যমে মানুষ শোক কাটিয়ে ওঠে এবং মানসিক ভারসাম্য ফিরে পায়। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিষয় নয়; বরং এটি মানবজীবনের এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন, যা "Coco" সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে।
'Coco'–এর অ্যানিমেশন কাজ ছিল পিক্সারের অন্যতম জটিল প্রকল্প। ৫ লাখের বেশি আলোর উপাদান (lighting elements) ব্যবহৃত হয়েছে শুধু মৃতদের শহরের দৃশ্য তৈরিতে। প্রতিটি চরিত্রের হাড়ের গঠন অ্যানিমেশনে দেখানোর জন্য বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছিলেন virtual bone system, যাতে বাস্তবের মতো নড়াচড়া দেখানো যায়।প্রতিটি দৃশ্যে রঙের মনস্তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে- জীবিতদের জগতে মাটির রঙ, মৃতদের জগতে উজ্জ্বল নিয়ন রঙ, যা প্রতীকীভাবে দেখায়, মৃত্যু ভয় নয়, বরং স্মৃতির আলোয় ভরা নতুন এক অধ্যায়।
'Coco' মূলত শেখায়-পরিবারের সঙ্গে সংযোগই জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
মিগুয়েল যখন বুঝতে পারে তার প্রপিতামহ কোনো বিশ্বাসঘাতক নয় বরং একজন সত্যিকারের শিল্পী ছিলেন, তখন সে শেখে ক্ষমা ও সম্মানের মানে। এই শিক্ষা বাস্তবেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ: আধুনিক সমাজে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হলেও, মানুষের মানসিক প্রশান্তির জন্য সেই সম্পর্ক অপরিহার্য।
'Coco'-এর বার্তা সরাসরি মানবমনের আবেগীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত, স্মৃতির প্রতি সম্মান ও স্মরণচর্চা (Remembrance Practice) মানুষের মানসিক স্থিতি ও সহমর্মিতা বাড়ায়।এটি Emotional Resilience বা আবেগীয় দৃঢ়তা তৈরি করে, যা মানুষকে শোক, একাকীত্ব বা বেদনা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।এ কারণেই "Coco" দেখা একধরনের আবেগীয় থেরাপির মতো। এটি আমাদের শেখায় কাঁদা, ভালোবাসা, এবং মনে রাখার গুরুত্ব।
'Coco' মুক্তির পর চলচ্চিত্র জগতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ২০১৮ সালে এটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার)-এ পেয়েছিল দুটি বড় পুরস্কার-
১। Best Animated Feature
২। Best Original Song ("Remember Me")
এছাড়াও সিনেমাটি Golden Globe, BAFTA, এবং Annie Awards সহ আরও বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল এই যে, বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মেক্সিকোর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছে।
'Coco' মূলত দেখায়, পরিবার কেবল একসঙ্গে থাকা নয়, বরং একে অপরকে মনে রাখা।
মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়, এটি স্মৃতির ধারাবাহিকতা। এই সিনেমা একাধারে দর্শন, মনোবিজ্ঞান ও শিল্পকলার নিখুঁত সম্মিলন।শেষ দৃশ্যে যখন কো'কো তার বাবার গান মনে করে চোখে পানি আসে, তখন বোঝা যায় সত্যিকারের সম্পর্ক কখনো মরে না; যতদিন কেউ মনে রাখে, ততদিন আমরা বেঁচে আছি।
'Coco' আমাদের শেখায় জীবন শুধু বেঁচে থাকার নয়, সংযোগে থাকার নাম। পরিবার, ভালোবাসা, স্মৃতি—এই তিনই মানুষের আসল শক্তি। এটি এমন এক চলচ্চিত্র, যা একদিকে চোখে জল আনে, অন্যদিকে হৃদয়ে আলোর স্রোত ছড়িয়ে দেয়।কারণ "Coco" শুধু দেখা যায় না, অনুভব করা যায়—একটি গান, একটি স্মৃতি, এবং একটি জীবনের মর্মস্পর্শী ছন্দে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।