একা পথে, একা মন-"Wild"-এর অবিশ্বাস্য যাত্রা যা বদলে দেবে আপনার জীবন!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষ কখনও কখনও জীবনের এমন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়, যেখানে অতীত, অনুশোচনা, আর আত্মদ্বন্দ্বের ভারে শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু হয় আত্মশুদ্ধির পথচলা। ২০১৪ সালের চলচ্চিত্র "Wild", পরিচালক জ্যাঁ-মার্ক ভ্যালি এবং চেরিল স্ট্রেইডের আত্মজীবনীমূলক বই অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি - এক নারীর সেই আত্ম-অন্বেষণের কাহিনি, যেখানে পাহাড়, নিঃসঙ্গতা, ভয়, এবং প্রকৃতি মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে আত্মার এক নির্মল রূপান্তর।
চেরিল স্ট্রেইড (Reese Witherspoon), জীবনের গভীর ক্ষত, মা'কে হারানোর বেদনা, ভাঙা সম্পর্ক এবং নিজের ভুলের ভারে ভেঙে পড়া এক নারী। তার জীবন যেন নিয়ন্ত্রণহীন এক স্রোত।
সব হারানোর পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক অসম্ভব যাত্রার, প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইল (Pacific Crest Trail) ধরে ১,১০০ মাইল দীর্ঘ একাকী পদযাত্রা। একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী নন, নেই বিশেষ প্রস্তুতিও, কিন্তু আছে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার এক অদম্য বিশ্বাস।এই দীর্ঘ পথেই ধীরে ধীরে মুছে যায় চেরিলের ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ, আত্মঘৃণা। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আত্মসমালোচনার এক পাঠ, প্রতিটি পাহাড় যেন এক নতুন উপলব্ধি। সিনেমাটি শুধু পাহাড় আর প্রকৃতির গল্প নয়, এটি এক নারীর নিজের ভেতর ফিরে যাওয়ার যাত্রা।
'Wild'-এর অন্যতম শক্তি হলো প্রকৃতির নির্মম অথচ নিরাময়ী উপস্থিতি। প্রকৃতি এখানে শুধু পটভূমি নয়; এটি এক 'চরিত্র'। রুক্ষ মরুভূমি, তুষারাচ্ছন্ন শৃঙ্গ, বৃষ্টি, সূর্য, হিমশীতল বাতাস সব মিলেই যেন চেরিলের অন্তরের অস্থিরতার প্রতিফলন।তার ক্লান্ত শরীর, ফোস্কা-পড়া পা, একাকিত্বের ভয় সবকিছুই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজের সঙ্গে লড়াই। এই যাত্রায় প্রকৃতি তাকে শেখায় ধৈর্য, স্বীকৃতি, আর আত্মসমর্পণ। যেমন, পাহাড় ধীরে ধীরে উঠে যেতে হয়, তেমনই জীবনের বোঝাও এক পা এক পা করে পার হতে হয়।
সিনেমাটি মানুষের মনের গভীর স্তরগুলো- দুঃখ, অপরাধবোধ, শোক, স্মৃতি আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা- কে স্পর্শ করে । চেরিলের একাকিত্বের মধ্যে শুরু হয় এক আত্মিক সংলাপ, যেখানে তিনি মুখোমুখি হন নিজের দুর্বলতার, অনুশোচনার এবং ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এই যাত্রা এক প্রকার "Cognitive Rebirth"। মানুষ যখন গভীর সংকটে পড়ে, তখন নিজের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করে নতুনভাবে বাঁচতে শেখে।চেরিলের জন্য এই পথচলা শুধু আত্মদণ্ড নয়, বরং এক ধরনের মানসিক পরিশুদ্ধি ।
সিনেমাটি আধুনিক সমাজে নারীর স্বাধীনতা, সংগ্রাম এবং আত্মপরিচয়ের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে।চেরিলের যাত্রা সমাজের কোনো মানদণ্ডে ফিট করে না। তিনি কারও স্ত্রী, কন্যা বা প্রেমিকা নন, বরং এক স্বতন্ত্র মানুষ, যে নিজের ভুল স্বীকার করেও দাঁড়াতে জানে।তার ব্যাকপ্যাক, ছেঁড়া জুতো, ধুলো-মাখা মুখ সবই প্রতীক তার জীবনের বাস্তব লড়াইয়ের। এই সিনেমা নারীর সেই ভয়হীন অবস্থানের গল্প বলে, যেখানে সে নিজের ত্রুটি, শোক, ভুল সব কিছু নিয়েই সম্পূর্ণ।
রিস উইদারস্পুনের সংযত অথচ গভীর অভিনয় পুরো গল্পটিকে বাস্তব ও মানবিক করে তুলেছে। তার মুখের ক্লান্তি, চোখের ভয়, আবার কখনো অবাধ হাসি- সবই যেন দর্শককে টেনে নেয় সেই একাকী পথে। চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন একেবারে প্রাকৃতিক- সূর্যোদয়, তুষারপাত, পায়ের নিচের ধুলা সবকিছুই এত বাস্তব যে মনে হয় দর্শকও যেন সেই ট্রেইলে হাঁটছেন। সঙ্গীত ও সাউন্ড ডিজাইনও চরিত্রের মনের ওঠানামাকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
"Wild" কোনো রোমাঞ্চ বা ভ্রমণকাহিনি নয়; এটি আত্মমুক্তির এক আধ্যাত্মিক যাত্রা। যে মানুষ অতীতের ভারে দমে গেছে, সে যেন প্রকৃতির কোলেই ফিরে পায় নিজের অস্তিত্ব। এই সিনেমা আমাদের শেখায়, কখনো কখনো পথ হারানোই হলো নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সূচনা। চেরিলের মতো আমাদেরও প্রয়োজন এমন এক 'বন্য' সময়, যেখানে একাকিত্ব, ভয় আর প্রকৃতিই শেখাবে জীবনের আসল মানে। কারণ, সত্যিকারের সাহস মানে নিজের ভেতরের ভাঙনটাকে মেনে নেওয়া, আর তবুও হাঁটতে থাকা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।