প্রশ্ন করা শেখানো হয় না, তাই ভিন্নমত মানতেই ভয়?- কৌতূহল হারানো সমাজের ভয়ঙ্কর সত্য!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ভালোভাবে ভাবলে দেখা যায়, একটি প্রশ্নই অনেক সময় সভ্যতার দিক বদলে দেয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা শেখানো না হয়, কী ঘটে? শিশুর প্রথম "কেন?" থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে প্রশ্ন করার সাহস - এসব ছেঁটে দিলে সমাজে কেবল জ্ঞানের ঘাটতি হবে না, প্রতিষ্ঠিত মতের বিরুদ্ধে ভয়ও জন্ম নেবে। আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক পরিবেশে, বিশেষ করে যেখানে অনুশাসন ও সম্মানকে অতিরিক্ত ওজন দেওয়া হয়, প্রশ্নকে আপত্তিকর বা অসম্মানের লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। এই লেখায় আমি যাচাই করে দেখাবো-প্রশ্নহীনতা কিভাবে ভিন্নমতকে ভয়জাগা করে, এর মানসিক ও সামাজিক বীজ কোথায়, কী পরিণতি হয়, আর কীভাবে ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত ও নীতি-স্তরে এই অবস্থা বদোলা সম্ভব।
প্রথমত, প্রশ্ন না করার প্রবৃত্তি কেবল শিক্ষা সমস্যাই নয়, এটি মনস্তাত্ত্বিক প্রসেস। যখন শিশু বা তরুণ কোনো ধারণা, নিয়ম বা কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করতে নিষেধ পায়—চুপ করো, প্রশ্ন করো না তখন তারা শেখে যে নিজস্ব জিজ্ঞাসা বিপদজনক। এই শিক্ষা কেবল মুহূর্তের জন্য নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়। নিজস্ব ধারণা খতিয়ে না দেখা, সন্দেহ না করা, এবং সহজভাবে যে কথাই বলা হয় তা গ্রহণ করে নেওয়ার মনোভাব তৈরি হয় । ফলে ভিন্নমত প্রতিষ্ঠার বা প্রকাশের আগ্রহ স্তব্ধ হয়। অন্যের সঙ্গে মতানৈক্য হলে লজ্জা, বিচ্ছিন্নতা বা জনসমক্ষে অপমানের ভয় কাজ করে। ভিন্নমত মানতেই ভয়—এই মনোভাবের মূল কারণই হল প্রশ্ন-চাপা সংস্কৃতি।
এখন এটি কিভাবে গঠিত হয়। এখানে পরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য। অনেক পরিবারে বড়দের সঙ্গে শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্পর্ক বজায় রাখতে শিশুদের শেখানো হয়—শ্রদ্ধাশীল হও, প্রশ্ন করলে ব্যাখ্যা না করো। যদিও শ্রদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শ্রদ্ধা এবং অশ্বচিন্তা ছাড়াই গ্রহণের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। যদি শ্রদ্ধাকে বাকচাপনের অজুহাত বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ক্ষতি হয়: শিশুর আত্মবিশ্বাস কাটা পড়ে, তর্ক-শক্তি বিকশিত হয় না, আর আত্মপ্রকাশের সাহস নষ্ট হয়।
একইভাবে, শিক্ষাপদ্ধতি পাঠ্যকেন্দ্রিক, পরীক্ষাভিত্তিক সিস্টেম যেখানে উত্তর সঠিক না হলে শাস্তি বা ঘামে পড়ার পরিবেশ, তাও প্রশ্নহীনতা ধারাকে শক্ত করে। অফিসেও যদি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা সিনিয়ররা প্রশ্নকে ব্যর্থতা বা বিরোধের সূচনা হিসেবে দেখেন, কর্মী নিজেদের মত প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। ফলে উদ্ভাবন, সমস্যা সমাধান ও কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভিন্নমত মানতে ভয় তৈরি হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সামাজিক শাস্তির ভীতি। সামাজিক কাঠামোয়, বিশেষ করে ছোট সম্প্রদায় বা ঘনিষ্ঠ সামাজিক নেটওয়ার্কে, ভিন্নমত ব্যক্তিকে বহিষ্কারের আশঙ্কা থাকতে পারে- gossip, সামাজিক বিচ্যুতি, অথবা শ্রমবাজারে অনুপযোগী বা অসম্মানজনক মনে হওয়া। মানুষ প্রাকৃতিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা খোঁজে। তাই সম্ভাব্য সামাজিক ব্যাঘাত এড়াতে মেনে নিলে নিরাপদ বোধ করে। ফলে ভিন্নমত ব্যক্ত হতে চাইলে যে ঝুঁকি আছে তা মানুষ এড়াতে চায়। এটাই ভিন্নমতকে ভয় করে তোলার আরেকটি কারণ।
মানসিকতাত্ত্বিক স্তরে দেখা যায় প্রশ্ন না করা মানে সংবেদনশীলতা ও সমালোচনামুক্ত চেতনা ঘাটে। সন্দেহ ও অনুসন্ধানকে দমন করলে বঞ্চিত হয় রেফ্লেকশন। অর্থাৎ নিজের আচরণ ও সিদ্ধান্তের উপর পুনরালোচনা। এ ধরনের দমনাকৃতি দীর্ঘমেয়াদে 'কগনিটিভ ডগমাতিসম' তৈরি করে একধরনের মানসিক স্থিততা যেখানে ব্যক্তিরা নিজেদের ধারণাকে প্রশ্ন করেন না, এমনকি স্পষ্টভাবে ভুল হলে তাও ঠিকঠাক বোঝার চেষ্টা করেন না। এর ফল স্বরূপ নীতিনির্ধারণী পঁয়তারা, প্রতিষ্ঠিত অনুমান এবং সামাজিক আচরণে ত্রুটি ধরে না। আর ত্রুটিগুলো সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে।
এক্ষেত্রে ভিন্নমতকে ভয় করে তোলা সমাজে তার ক্ষতি কেবল ব্যক্তিগত নয়। নীতিগত ও অর্থনৈতিক স্তরেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন-উত্থাপনের ওপর নির্ভরশীল- বিজ্ঞানী প্রশ্ন করেন, উদ্যোক্তা প্রশ্ন করেন, শিক্ষক প্রশ্ন করেন। যেখানে প্রশ্ন কাটা পড়ে, সেখানে নতুন সমাধান জন্মায় না, প্রযুক্তি ও সেবা অগ্রগতি হারায়।
একইভাবে, নৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে শক্তিশালী প্রশ্নহীনতা গণতন্ত্র ও উত্তকরীতির জন্যও হুমকি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকবে তখনই যখন নাগরিকরা সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রশ্ন রাখতে জানে, নীতির যৌক্তিকতা বিচার করে, সরকারি পদক্ষেপের প্রাসঙ্গিকতা জিজ্ঞাসা করে এবং জবাবদিহির দাবি করে। প্রশ্নহীন সমাজে ক্ষমতার অপব্যবহার সহজ হয়, কারণ প্রশ্ন নেই যে খতিয়ে দেখুক।
তাহলে সমাধান কোথায় আর কিভাবে শুরু করা যায়?
প্রথমত, পরিবারকে জিজ্ঞাসা উৎসাহিত করার ভূমিকা নিতে হবে। এটিই মৌলিক এবং সবচেয়ে দ্রুত প্রভাব দেখানোর জায়গা। শিশুর ছোটখাট প্রশ্নের প্রতিক্রিয়া যেন কেবল "চুপ করো" বা "এটা ঝামেলার" বদলে হয়—"চমৎকার প্রশ্ন, চল দেখি কেন তুমি এটা ভাবলে"। পিতামাতার আচরণে প্রয়োজন সচেতনতা। প্রশ্ন করলে ত্রুটির সুযোগ না দেখে সেটাকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলা। এভাবেই শিশুরা শিখবে বিশ্লেষণ করে ভাবতে, ভিন্নমত শুনতে এবং তর্ক-নিবিড় আলোচনায় অংশ নিতে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজন। পাঠ্যভিত্তিকতা ছাড়িয়ে আনা দরকার প্রকৃত পাঠক্রম, যেখানে আলোচনা, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষা, দলীয় বিতর্ক, এবং গবেষণা-মনোভাবের বিকাশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। শিক্ষকরা শুধু জ্ঞান প্রদায়ক নয়।তাদের ভূমিকা হবে প্রশ্নকেন্দ্রিক শিক্ষার উৎসাহকর্তা। পরীক্ষার কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে শুধু সঠিক উত্তর নয়, যুক্তি জাতীয় ব্যাখ্যা ও সমস্যার সমাধান ক্ষমতাকেই মূল্যায়ন করতে হবে। স্কুল পর্যায়ে নিয়মিত "প্রশ্ন আলোচনা ক্লাব" বা "ডিবেট সার্কেল" চালু করলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে প্রশ্ন উত্থাপন ও মতবিনিময় অনুশীলন করবে।
তৃতীয়ত, মিডিয়া ও সামাজিক নর্ম বদলানো দরকার। মিডিয়া যেন শুধুই সুনাম ধরা এবং প্রচলিত মতের পুনরাবৃত্তি না করে। মতান্তরে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, তর্ক-টীকা ও যুক্তিপূর্ণ বিতর্কের সুযোগ করে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোতেও অল্প সময়ে ট্রলিং বা দমন হওয়ার ভয়ে মানুষ চুপ করে থাকে।এতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নীতি ও ব্যবহারগত সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্নমতকে সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা সামাজিক নর্মে ব্যাপকভাবে প্রসার করতে হবে, পরস্পরের বক্তব্যের মৌলিক মর্যাদা স্বীকার করা শিখতে হবে।
চতুর্থত, কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসক ও ম্যানেজারদের উচিত এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে ভুল বলা বা প্রশ্ন উত্থাপন করা নিরাপদ। 'ফেইল-ফ্যায়ার' (fail-safe) ও 'লোকাল লার্নিং' (local learning) সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।অর্থাৎ ভুল হলে শুধুমাত্র দণ্ড নয়, বরং শিখনও ঘটবে। এমন সাংস্কৃতিক পরিবেশে কর্মীরা ভিন্নমত প্রকাশ করতে ছাড়পত্র পায়। ফলস্বরূপ সংস্থা উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পায় ও ঝুঁকি-প্রশাসন উন্নত হয়।
অন্তরে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস গড়তে চাইলে কিছু ব্যবহারিক কৌশল সাহায্য করে।যেমন - নিজের মত ছোট ছোট জায়গায় প্রথমে ব্যক্ত করা, নিরাপদ বন্ধু বা সমর্থনগোষ্ঠীর সঙ্গে অনুশীলন করা, বিতর্কে তথ্য-ভিত্তিক যুক্তি খোঁজা ও নিজের বক্তব্য নরমভাবে উপস্থাপন শেখা। আত্ম-চিন্তা (self-reflection) নিয়মিত অনুশীলন মানুষকে নিজের ভাবনার ত্রুটি বুঝতে অনুপ্রাণিত করে, যা পরবর্তীতে ভিন্নমত গ্রহণের সহনশীলতা বাড়ায়।
সবশেষে, প্রশ্নহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই কেবল শিক্ষার বদল বা পরিবারের সংস্কারের প্রশ্ন নয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক মন্ত্রের পরিবর্তন। প্রশ্ন করা মানে কুখ্যাতি নয়, তা হলো জ্ঞানের সম্মান। ভিন্নমত মানা মানে দুর্বলতা নয়, তা হলো সাংঘর্ষিক হলেও সদিচ্ছা ও সহনশীলতার পরিচায়ক। যেখানে প্রশ্ন-বহুল পরিবেশ থাকবে, সেখানে সমাজ সমৃদ্ধ হবে-উদ্ভাবনে, ন্যায়বিচারে, এবং মানসিক সুস্থতায়।
প্রশ্ন করা শেখানো না হলে ভিন্নমত স্বাভাবিকভাবেই ভয় তৈরি করে। এটি শিক্ষা, পরিবার ও সামাজিক নর্মের সমন্বিত ফল। তবে এই ভয়কে প্রতিহত করা যায়। পরিবর্তন শুরু হয় ছোট থেকে, পরিবারের ঘর থেকে, স্কুলের ক্লাসরুম থেকে, অফিসের মিটিংরুম থেকে। এক একজন প্রশ্নকারী মানুষ সমাজে ভিন্নমতকে নিরাপদ করে। তাই কৌতূহলকে হত্যা না করে বিকাশে উৎসাহ দিন-প্রশ্নই সক্রিয়, সমৃদ্ধ ও পরিচর্যাশীল সমাজের মূল শক্তি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।