হাইলি গুবি আগ্নেয়গিরি: আফ্রিকার বুকের নিচে লুকানো অগ্নি দানব, যে একদিন পৃথিবী গ্রাস করতে পারে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
পৃথিবীর এমন কিছু ভূখণ্ড আছে যেখানে ভূমি শুধু ভূমি নয়, ভূত্বকের নড়াচড়ার প্রতিটি ধাপে একটি অদৃশ্য কাহিনি, এক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, এক ভয়ঙ্কর সুন্দর শক্তি লুকিয়ে থাকে। পূর্ব আফ্রিকার Afar অঞ্চলের আগ্নেয় মালভূমি ঠিক সেই রহস্যময় পৃথিবির অন্যতম। আর এই অঞ্চলের ব্যতিক্রমী, কম পরিচিত, কিন্তু ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আগ্নেয়গিরিদের মধ্যে হাইলি গুবি (Hayli Gubi) আগ্নেয়গিরি গবেষকদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অনেক বছর ধরেই।
ইথিওপিয়ার আগ্নেয়গিরি অঞ্চল Afar Depression–এ অনেক কম পরিচিত ও আংশিক-নথিভুক্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। 'Hayli Gubi' নামটি সেই অঞ্চলের এক গঠনকে নির্দেশ করে, যাকে কখনও কখনও Gubi volcano / Gubi maar field হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
এই আগ্নেয়গিরির নামটি হয়তো বিখ্যাত এর্তা আলে বা ডানাকিল ডিপ্রেশনের মত বিশ্বমঞ্চে পরিচিত নয়। কিন্তু এর অভ্যন্তরে যা ঘটছে, তা যে কোন জিওসায়েন্টিস্ট বা আগ্নেয়গিরি গবেষকের কাছে এক অমূল্য তথ্যভাণ্ডার। কারণ হাইলি গুবির অবস্থান পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় রিফটিং অঞ্চলের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। সেখানে আফ্রিকান প্লেট ও আরবিয়ান প্লেট দুটি আলাদা হওয়ার ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ভূ-পৃষ্ঠকে টেনে ছিন্ন করে দিচ্ছে। এই ভূমিকম্পপ্রবণ, আগ্নেয়গিরি-সমৃদ্ধ অঞ্চলের নীরবতা কখনও কখনও ভয়ঙ্কর সংকেত, আবার কখনও শান্ত, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন ভূপ্রকৃতি। হাইলি গুবি সেই রূপান্তরেরই এক নীরব উদাহরণ।
চলুন ধীরে ধীরে প্রবেশ করি হাইলি গুবির ভূতাত্ত্বিক রহস্যে—তার সৃষ্টি, গঠন, উপাত্ত, এর চারপাশের পরিবেশ, গবেষণার অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
অফার ট্রাইএঙ্গেলের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাইলি গুবি:
ইথিওপিয়ার Afar Depression পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় রিফট ভ্যালি। এখানে তিনটি টেকটোনিক প্লেট একত্রে মিলিত হয়েছে, যাকে বলা হয় Afar Triple Junction। তিনটি প্লেট হলো:
⇨ আফ্রিকান নুবিয়ান প্লেট
⇨ সোমালি প্লেট
⇨ আরবিয়ান প্লেট
এই তিন প্লেটের ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াই অঞ্চলটিকে আগ্নেয়গিরি, লাভা সমতল, ম্যাগমা মণ্ড এবং তাপীয় পরিবর্তনের জন্য বিশ্বখ্যাত করেছে। এই বিশাল রিফট অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বহু maar-type volcano, scoria cone, shield volcano, এবং lava field। হাইলি গুবি এই শ্রেণির একটি maar-dominated volcanic structure, যা বিস্ফোরণমূলক ক্রিয়া ও ভূত্বকের নিচে ম্যাগমা-পানির সংঘর্ষে সৃষ্টি।
Maar আগ্নেয়গিরি কী?
Maar volcano হলো আগ্নেয়গিরির এমন একটি ধরন যেখানে ম্যাগমা ভূগর্ভস্থ পানি বা জলাধারের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে মাটি ও শিলা ছেড়ে তৈরি হয় একটি বিস্তৃত গর্ত, যাকে বলে maar crater। হাইলি গুবির ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়—এখানে বারবার ছোট কিন্তু শক্তিশালী ফ্রিয়াটোম্যাগম্যাটিক বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রতিটি বিস্ফোরণে চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলা, অ্যাশ ও স্কোরিয়া ছিটকে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে এটি তৈরি করেছে একটি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার crater field।
হাইলি গুবির ভৌগোলিক অবস্থান ও চারপাশের পরিবেশ
Afar Depression–এর পরিবেশ পৃথিবীর বুকে অন্যতম কঠোর পরিবেশ হিসেবে পরিচিত। তাপমাত্রা অনেক সময় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ওঠে। এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য:
◑ শুষ্ক, মরুভূমির মতো আবহাওয়া
◑ লবণসমতল, শুকনা হ্রদ (playa lakes)
◑ বিস্তৃত লাভা প্রবাহ
◑ আগ্নেয় ছাইয়ের স্তর
ক্রমাগত ফাটল ও ভূত্বকের নিচে magma intrusion
হাইলি গুবির চারপাশে পাওয়া উপাদানগুলো থেকে বোঝা যায়, বিস্ফোরণ পরবর্তী সময় lava spatter ও lapilli জমে একটি বিস্তৃত আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আশেপাশের আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্রের সাথে এর ভৌগোলিক সংযোগ উল্লেখযোগ্য, কিন্তু প্রতিটিই নিজেদের কার্যপ্রবাহে আলাদা। Afar অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের এত বেশি নড়াচড়া হয় যে, গবেষকেরা এখানে প্রতি বছরে নতুন ফাটলের মানচিত্র তৈরি করেন, যা আগ্নেয়গিরির ভবিষ্যৎ আচরণ অনুমান করতে সাহায্য করে।
কিভাবে তৈরি হলো এই আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্র?
হাইলি গুবির গঠনকে কয়েকটি ধাপে ব্যাখ্যা করা যায়—
১. টেকটোনিক ফাটল সৃষ্টি- Afar অঞ্চলে পৃথিবীর ভূত্বক অত্যন্ত পাতলা ও দুর্বল। টেকটোনিক প্লেট আলাদা হওয়ার কারণে নিচের ম্যাগমা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করে। এই উত্তোলনে ভূ-পৃষ্ঠে ফাটল তৈরি হয়—হাইলি গুবির গঠন এই প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ।
২. ম্যাগমা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংঘর্ষ- Afar অঞ্চলে শুষ্ক আবহাওয়া হলেও ভূগর্ভে পানি বা লবণাক্ত তরল কাঠামো থাকে। ম্যাগমা সেই পানির সংস্পর্শে এলে ঘটে প্রচণ্ড বাষ্প চাপ, বিস্ফোরণ, বিশাল গর্ত বা মাউথ তৈরি, ছাই-পাথরের স্তর।
৩. Maar crater গঠন- প্রতিটি বিস্ফোরণের পর বিস্তৃত crater তৈরি হয়। হাইলি গুবি অঞ্চলে এমন একাধিক চিহ্ন পাওয়া যায়, যা নির্দেশ করে এটি এককালীন নয়, বহু বিস্ফোরণের ধারাবাহিক ফল।
৪. বিস্তার ও জমাট গঠন- বিস্ফোরণের পর ম্যাগমা ঠান্ডা হয়ে স্কোরিয়া, লাভা ব্লক ও টাফে পরিণত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো মিলে একটি বিস্তৃত maar field গঠন করেছে।
বিস্ফোরণের ইতিহাস:
Hayli Gubi–র বিস্ফোরণ ইতিহাস স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত নয়। কারণ-
⇨অঞ্চলটি অত্যন্ত দুর্গম
⇨ দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক গবেষণা সীমিত ছিল
⇨ বিস্তারিত স্যাটেলাইট তথ্যও তুলনামূলক নতুন
তবুও স্যাটেলাইট ইমেজ, ভূ-রাসায়নিক বিশ্লেষণ এবং আগ্নেয় স্তর অধ্যয়ন করে গবেষকেরা কয়েকটি বিষয়ের ওপর একমত-
১. এটি Holocene সময়ে সক্রিয় ছিল। Holocene মানে শেষ ১০–১২ হাজার বছরের মধ্যে। অর্থাৎ হাইলি গুবি খুব প্রাচীন আগ্নেয়গিরি নয় বরং ভৌগোলিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ।
২. পরপর একাধিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। পুরো crater field–এর বিন্যাস দেখে বোঝা যায়, একটি মাত্র ঘটনার নয়। টুকরো টুকরো আলাদা বিস্ফোরণে সমগ্র গঠনটি তৈরি।
৩. lava flow অপেক্ষাকৃত সীমিত। এটি বেশি বিস্ফোরণমুখী (explosive) আগ্নেয়গিরি, effusive নয়। অর্থাৎ প্রচুর লাভা নদীর মতো বের হয়নি, বরং বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া শিলা ও ছাই জমে কাঠামো তৈরি হয়েছে।
গবেষণায় হাইলি গুবির গুরুত্ব
হাইলি গুবির মতো অল্প পরিচিত maar volcano বিজ্ঞানীদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ-
১. পৃথিবীর রিফটিং (Rifting) প্রক্রিয়া বোঝা যায়! মানবসমাজ রিফটিং ধীরে ধীরে কিভাবে ঘটছে, এবং ভূত্বক কিভাবে ভেঙে নতুন সমুদ্রগর্ভ তৈরি করছে, তা বুঝতে হাইলি গুবির মতো গঠনের গভীর বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
২. এ অঞ্চলে বিস্ফোরণমূলক আগ্নেয়গিরি কম পরিচিত হলেও বিপজ্জনক। Maar বিস্ফোরণ খুব অপ্রত্যাশিত ও শক্তিশালী হতে পারে।
৩. Afar অঞ্চল ভূ-তাপীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ। হাইলি গুবির নিচে ম্যাগমা চেম্বার বা তাপীয় সিস্টেমের উপস্থিতি নতুন শক্তির উৎস হিসেবে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
৪. Maars অনেক সময় জলাধার হয়ে যায়। তাদের পলি স্তর জলবায়ুর প্রাচীন পরিবর্তনের বিশ্বস্ত রেকর্ড রাখে। হাইলি গুবির আশেপাশের টাফ স্তর সেই ঐতিহাসিক তথ্য ধারণ করতে পারে।
হাইলি গুবির চারপাশের সমাজ ও স্থানীয় মানুষের জীবন-
Afar অঞ্চল মূলত আধা-যাযাবর সম্প্রদায়ের বাসস্থান। মানুষ এখানের কঠোর আবহাওয়া, পানির সীমাবদ্ধতা ও আগ্নেয় কার্যকলাপের সঙ্গে সহাবস্থান করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। অনেকেই লবণ খনন ও বেচাকেনায় জীবিকা নির্বাহ করেন। আগ্নেয় সমতলের আশেপাশে পশুপালনও প্রচলিত ।
আগ্নেয়গিরির উর্বর মাটিতে কিছু মৌসুমি ফল বা ঘাসও জন্মে। যদিও হাইলি গুবির বিস্ফোরণ ইতিহাস আধুনিক যুগে নেই, তবুও স্থানীয়রা অঞ্চলের অস্থির ভূত্বক সম্পর্কে সচেতন।
হাইলি গুবি কি আবার বিস্ফোরিত হতে পারে?
কোনও আগ্নেয়গিরির ভবিষ্যৎ আচরণ নিশ্চিতভাবে আগে থেকে বলা কঠিন। তবে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দেখে বিজ্ঞানীরা কয়েকটি বিষয় অনুমান করেন—
১. Afar Rift অত্যন্ত সক্রিয় অর্থাৎ ভূত্বকের নিচে গরম ম্যাগমা নিয়মিত চলাচল করছে।
২. পুরনো maar crater–গুলো এখন শান্ত, কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়। নিষ্ক্রিয় (extinct) আগ্নেয়গিরির মতো স্থায়ীভাবে নিস্তেজ হওয়ার প্রমাণ নেই। বরং এগুলো dormant বা "ঘুমন্ত" ধরণের।
৩. অঞ্চলে সাম্প্রতিক বারবার ছোট ছোট ভূকম্পন ম্যাগমা চলাচলের ইঙ্গিত হতে পারে।
সুতরাং ভবিষ্যতে হাইলি গুবি বা আশেপাশের আগ্নেয়গিরিগুলো আবার সক্রিয় হতে পারে—এ সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বাতিল করা যায় না।
হাইলি গুবি একটি ভূতাত্ত্বিক রহস্যের ভেতর থেকে উঠে আসা শিক্ষণীয় বার্তা
প্রকৃতি কখনও কখনও অতিমাত্রায় ধীর, কখনও আবার এক মুহূর্তে ভেঙে দেয় নীরবতার সমস্ত দেয়াল। হাইলি গুবির মতো আগ্নেয়গিরি আমাদের শেখায়—
পৃথিবী সবসময় নড়াচড়া করছে। ভূত্বকের গভীরে অদৃশ্য শক্তির লড়াই চলছেই।পৃথিবীর পরিবর্তন কখনও লক্ষ বছর ধরে হয়,কখনও কয়েক সেকেন্ডেই ঘটে যায়। মানুষের সভ্যতা যতই অগ্রসর হোক, পৃথিবীর অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শক্তি আজও রহস্যময়। ইথিওপিয়ার কঠোর, উষ্ণ, শুষ্ক Afar ভূমি শুধু বিপজ্জনক নয়। এটি পৃথিবীর জন্ম-পর্ব, ভূত্বকের গঠন এবং ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের এক বাস্তব পাঠশালা। হাইলি গুবি সেই পাঠশালার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
হাইলি গুবি এমন একটি আগ্নেয়গিরি যার নাম হয়তো খুব পরিচিত নয়, কিন্তু যার ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু একটি গর্ত নয়, এটি পৃথিবীর রিফটিংয়ের সরাসরি প্রমাণ, একটি জীবন্ত ভূতাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি। হাইলি গুবির প্রতিটি স্তর পৃথিবীর হাজার বছরের পরিবর্তনের সাক্ষ্য। তার ছাই, তার টাফ, তার crater—সবকিছু বলছে, পৃথিবীর ভেতরে আগুন এখনও নিভে যায়নি। পৃথিবী এখনও তৈরি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এই অঞ্চল নতুন ভূপ্রকৃতি উপহার দিতে পারে। মানবসমাজের জন্য শিক্ষা, যেখানে নীরবতা, সেখানেই কখনও কখনও সবচেয়ে গভীর পরিবর্তন লুকিয়ে থাকে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।