গ্রহাণুর ধ্বংসযজ্ঞে ডাইনোসররা মুছে গেলেও-ফুলেরা কীভাবে বেঁচে রইল? প্রকৃতির এক বিস্ময়কর গল্প !
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
৬৬ মিলিয়ন বছর আগের এক ভয়াবহ দিনে পৃথিবী এমন একটি আঘাত পেয়েছিল, যা শুধু প্রাণীগুলোর নয়, পুরো জীবমণ্ডলের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। বিশাল এক গ্রহাণু আজকের মেক্সিকোর নিকটবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানলে পৃথিবীর পরিবেশ মুহূর্তেই বদলে যায়। আকাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে, আগুনে পুড়ে যায় বিশাল বনভূমি, এবং পরবর্তী কয়েক বছরে সূর্যালোক ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় ঘন ধুলোর চাদরের নিচে। এমন ভয়াবহ পরিবেশে পৃথিবীর রাজা বলে পরিচিত ডাইনোসররা টিকতে পারেনি। তারা নিঃশেষ হয়ে যায় চিরতরে।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো এই একই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে বহু প্রকার ফুলগাছ (Angiosperms) টিকে থাকে, ধীরে ধীরে পুনরায় বিস্তারও লাভ করে। প্রশ্ন জাগে একই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ফুলেরা কীভাবে বেঁচে রইল, আর ডাইনোসররা কেন পারল না?
যে গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত করে, তার ব্যাস প্রায় ১০ কিলোমিটার। ধাক্কার শক্তি ছিল পরমাণু বোমার তুলনায় কোটি গুণ বেশি। মুহূর্তেই আকাশে আগুনের গোলা ছুটে যায়, বিশাল বায়ুকম্পে প্রাণীদেহ ছিন্নভিন্ন হয়, বনের বড় অংশ জ্বলে ছাই হয়ে যায়, ধুলোর মেঘ সূর্যালোক আটকে দেয়। এটি শুধু একটি দিন বা সপ্তাহের বিপর্যয় নয়; বরং পৃথিবীর তাপমাত্রা, আলো, খাদ্যচক্র, আবহাওয়া সবকিছুই বদলে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য। ডাইনোসরদের জন্য এটি ছিল মৃত্যুঘণ্টা। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কিছু জীবের জন্য সৃষ্টি হয় নতুন সম্ভাবনা। ফুলগাছ ছিল তাদের অন্যতম।
মহাবিপর্যয়ের পর ডাইনোসরদের সামনে তিনটি প্রধান সমস্যা দাঁড়ায়-
১. খাদ্যচক্র ভেঙে পড়া: গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তৃণভোজী ডাইনোসররা খাদ্য হারায়।
তৃণভোজীদের মৃত্যু বাড়লে মাংসাশীরাও খাদ্য হারাতে থাকে। চক্রটি কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
২. আকারের কারণে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা বেশি: বৃহদাকার দেহধারী হওয়ায় তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত বিশাল পরিমাণ খাদ্য লাগত। বিপর্যয়ের পর এত খাদ্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
৩. দ্রুত পরিবেশ পরিবর্তনে অভিযোজন অক্ষমতা: ডাইনোসরদের বিবর্তনে বহু শক্তি ছিল। তবে দ্রুত পরিবর্তন মেনে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল সীমিত। মহাপরিবর্তন তাদের প্রতিযোগিতায় অক্ষম করে। এভাবে, বিপর্যয়ের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, ডাইনোসররা তত দ্রুত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়।
ফুলেরা কীভাবে টিকে গেল, উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের বিবর্তনগত বৈশিষ্ট্যে:
ফুলগাছ বা Angiosperms ছিল তুলনামূলক নবীন বিবর্তন। তাদের দেহ, বীজ, পাতার গঠন ও জীবনচক্র ছিল পরিবেশ পরিবর্তন সহনশীল।
ফুলগাছের বেশিরভাগই প্রচণ্ড বড় দেহ নয়; বরং ছোট থেকে মাঝারি আকার। এতে করে-
◑ কম পুষ্টিতেও বাঁচতে পারে।
◑ কম তাপমাত্রায়ও কিছু প্রজাতি টিকে থাকে।
◑ নতুন পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে।
বিপর্যয়ের পর এমন গাছই সুবিধা পায় যাদের বেঁচে থাকতে বড় পরিমাণ খাদ্য বা আলো প্রয়োজন ছিল না। ডাইনোসররা এই সুবিধা পায়নি।
ফুলগাছের বীজ প্রকৃতির সবচেয়ে বড় লাইফবোট হিসেবে কাজ করে।
কারণ, ধুলার ঝড়ে আলো কমলেও বীজ মাটির নিচে নিরাপদ থাকে। আগুন লাগলেও বীজের বড় অংশ অক্ষত থাকে। ঠান্ডায় বা খরায় বহু দিন সুপ্ত (Dormant) থাকতে পারে।
পরিবেশ একটু সহনীয় হলেই আবার অঙ্কুর গজায়
ডাইনোসরের ক্ষেত্রে এমন সুরক্ষা ছিল না। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম টিকে থাকতে হলে ডিমকে নিরাপদ পরিবেশ দরকার ছিল, যা বিপর্যয়ের পর আর ছিল না। অন্যদিকে একটি ছোট বীজ নিরুপদ্রবভাবে বছর বছর মাটির নিচে অপেক্ষা করতে পারে। এ যেন প্রকৃতির নিজের বীমা পরিকল্পনা।
বহু ফুলগাছ খুব দ্রুত বড় হয়। মহাবিপর্যয়ে বনভূমি পুড়ে গেলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আগাছা, ঘাস, ছোট মৌসুমি ফুল আগে বাড়তে শুরু করে। এরা আলো কম হলেও তুলনামূলকভাবে আলো গ্রহণে দক্ষ। এই দ্রুত বৃদ্ধি পৃথিবীর পরিবেশ পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ। দিনের পর দিন আকাশ কালো থাকলেও এই ছোট উদ্ভিদগুলোই নতুন আলো পরিবেশে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিল।
ফুলগাছ শুধু বীজের উপর নির্ভর করে না। তারা বিভিন্নভাবে ছড়াতে এবং বংশবিস্তার করতে পারে বীজ, কন্দ, মূল, শাখা ছড়িয়ে বায়ুর মাধ্যমে,
পানির মাধ্যমে। এই বহুমুখী কৌশল তাদের শুষ্ক, অন্ধকার বা আগুনে পোড়া জমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। বিপর্যয়ের পর পৃথিবী ছিল পরিবর্তনের পরীক্ষাগার, যেখানে যারা বহুমুখী কৌশল জানে তারাই টিকে থাকে।
গ্রহাণুর ধাক্কায় আকাশে যে ধুলোর চাদর তৈরি হয়েছিল, তা সূর্যালোককে অনেকটাই বাধা দিত। কম আলোর এই যুগে যে উদ্ভিদ আলো সংগ্রহে দক্ষ, তারাই সুবিধা পেল। ফুলগাছের পাতায় বিশেষ ধরনের টিস্যু থাকে যা, কম আলোর মধ্যে ফটোসিন্থেসিস বজায় রাখতে পারে। আলো কমে গেলে পাতা নিজস্ব প্রক্রিয়া সামঞ্জস্য করতে পারে। শীতল বা অন্ধকার পরিবেশেও জীবনচক্র টিকিয়ে রাখতে পারে। অন্যদিকে বড় গাছগুলো পতন শুরু করলে ছোট উদ্ভিদগুলো জায়গা দখল করে নেয়।
বড় গাছ বা ডাইনোসরের তুলনায় ফুলগাছের প্রাকৃতিক প্রয়োজনীয়তা ছিল কম-
⇨ কম পানি
⇨ কম পুষ্টি
⇨ কম আলো
⇨ দ্রুত পুনরুৎপাদন
⇨ ছোট জীবনচক্র
⇨ স্বল্প সময়ে পরিপক্বতা
তাই বিনাশের মাঝেও তাদের জীবনচক্র পুরোপুরি থেমে যায়নি। পরিবেশ একটু উন্নতি হলে তারা আবার বিস্তার শুরু করে।
গ্রহাণু আঘাতের পরেও কিছু পোকামাকড় টিকে থাকে। বিশেষত যেগুলো, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকতে পারে, সুপ্ত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে। এই পোকামাকড় পরবর্তীতে ফুলের পরাগায়নে ভূমিকা রাখে। যেখানে বৃহৎ প্রাণীরা একের পর এক বিলুপ্ত, সেখানে ছোট জীবেরা টিকে যায় এবং তাদের টিকে থাকা ফুলগাছের টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও বাড়ায়।
বিপর্যয়ের পর পৃথিবী ছিল জ্বলে যাওয়া ভূমি, ধ্বংসস্তূপ, ধুলার আচ্ছাদন। এই অবস্থায় প্রথম যে প্রাণীগোষ্ঠী পৃথিবীকে আবার সবুজ করতে শুরু করে, তারা হলো ছোট ফুলগাছ। দ্রুত মাটি শক্ত করে, পুষ্টি পুনর্গঠন করে, ক্ষুদ্র প্রাণীর খাদ্য তৈরি করে, ছোট বনভূমির সূচনা করে, নতুন ইকোসিস্টেম গড়ে তোলে। এই জীবনের প্রথম স্তর প্রতিষ্ঠা পায় ফুলেদের হাত ধরে। ডাইনোসরের যুগ শেষ হয়ে গেলেও, এই নতুন সবুজায়নই পরে পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য পরিবেশ তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রহাণুর আঘাত ছিল এক ধরনের প্রাকৃতিক রিসেট বাটন। যে প্রাণীরা দ্রুত বদলাতে পারে, স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তারাই বেঁচে যায়। ফুলেরা ছিল সেই তালিকার শীর্ষে। তাদের বহুমুখী প্রজনন, দ্রুত বৃদ্ধি, ছোট জীবনচক্র, পরিবেশ সহনশীলতা,বীজের স্থায়িত্ব- এ সবই একসাথে কাজ করেছে।
একই ধ্বংসযজ্ঞে কেউ মরে যায়, কেউ বেঁচে যায়-এই বৈপরীত্য প্রকৃতির এক চিরন্তন সত্য। গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীগোষ্ঠী, ডাইনোসর, যেখানে টিকতে পারেনি, সেখানে ফুলেরা নীরবে টিকে রইল, আবার বিস্তারও করল। শক্তিতে নয়, প্রকৃতির চোখে গুরুত্বপূর্ণ হলো—অভিযোজন। যারা দ্রুত বদলাতে পারে, তারাই বেঁচে থাকে। ফুলেরা দেখিয়ে দিয়েছে বৃহত্ত্ব বা ক্ষমতা নয়, ভবিষ্যৎ জেতে স্থিতিস্থাপকতা। মানুষের সভ্যতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আধুনিক জীববৈচিত্র্য সবকিছুর ভিত্তিতে রয়েছে এই ছোট, নীরব, স্থিতিস্থাপক ফুলেদের টিকে থাকা। ডাইনোসরদের পতন তাই শুধু একটি প্রজাতির বিলুপ্তি নয়। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যার মূলে ছিল ফুলেদের অদম্য জীবনশক্তি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।