অগ্নি দুর্ঘটনায় দ্রুত, নিরাপদ এবং কার্যকর পদক্ষেপে কী করতে হবে-জেনে নিন সবকিছু
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আগুন মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। আগুনের সাহায্যে মানুষ খাদ্য সিদ্ধ করতে শিখেছে, রাতের অন্ধকারে উষ্ণতা পেয়েছে, প্রাণী আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে আগুনের বিপদ কোনো সময় কম নয়। বাসায় বা আশেপাশের পরিবেশে নিয়ন্ত্রণহীন আগুন মুহূর্তের মধ্যে প্রাণহানি এবং বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ছোট অবহেলা কখনো কখনো পুরো পরিবারের জীবন বিপন্ন করতে পারে। তাই বাসাবাড়িতে আগুন লাগলে কী করতে হবে, এই বিষয়টি প্রতিটি পরিবারের জন্য অপরিহার্য।
আগুন জ্বলার জন্য তিনটি মৌলিক উপাদান অপরিহার্য:
◑ তাপ (Heat): কোনো পদার্থকে তার জ্বলন বিন্দুতে পৌঁছাতে হবে।
◑ অক্সিজেন (Oxygen): আগুন জ্বালাতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকা আবশ্যক।
◑ দাহ্য পদার্থ (Fuel): কাঠ, কাগজ, তেল বা যে কোনো জ্বলনযোগ্য বস্তু।
এই তিনটি উপাদান যখন নির্দিষ্ট মাত্রায় একত্রিত হয়, তখনই আগুন সৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ কয়লার জ্বলন বিন্দু প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি তাপ, অক্সিজেন এবং কয়লা একই বিন্দুতে একত্রিত হয়, আগুন অনিবার্য।তবে আমাদের চারপাশে সবসময় তাপ, অক্সিজেন ও দাহ্য পদার্থ থাকা সত্ত্বেও আগুন সবসময় জ্বলে না। কারণ এগুলো কখনও নির্দিষ্ট জ্বলন বিন্দুতে একত্রিত হয় না। এটি আগুনের নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি, আগুন নেভাতে হলে এই তিনটির যেকোনো একটি উপাদান আলাদা করতে হবে।
বাসায় আগুন লাগার প্রধান কারণ:
বাসাবাড়িতে আগুন সাধারণত ঘটে নিম্নলিখিত কারণে:
☞ বৈদ্যুতিক ত্রুটি: পুরনো বা ক্ষতিগ্রস্ত তার, অতিরিক্ত ভোল্টেজ বা শর্ট সার্কিট।
☞ রান্নাঘরের তেলের আগুন: অতিরিক্ত গরম তেল, চর্বি বা কড়াইয়ের তাপ।
☞ অনুপ্রবেশকারী আগুন: বাইরে থেকে আগুনের বিস্তার বা লাইটার/মোমবাতি ব্যবহার।
☞অসংযত বৈদ্যুতিক যন্ত্র: হিটার, মাইক্রোওয়েভ, টোস্টার বা ব্লেন্ডার।
প্রায়ই আমরা মনে করি ছোট আগুন সামলানো সহজ। কিন্তু দেরি হলে ছোট আগুনও মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাড়ি ধরতে পারে। তাই আগুনের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকা জরুরি।
বৈদ্যুতিক আগুন, যেভাবে প্রতিকার করবেন!
বৈদ্যুতিক আগুন সবচেয়ে বিপজ্জনক কারণ এতে পানি ব্যবহার করা গেলে বিদ্যুৎ আপনার শরীরেও প্রবাহিত হতে পারে। করণীয়-
⇨ ফায়ার সার্ভিসে কল করুন। আগুন সামাল দেওয়ার আগে পেশাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সবচেয়ে নিরাপদ।
⇨ বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করুন। আগুন ছোট হলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মেইন সুইচ বা নির্দিষ্ট যন্ত্রের বিদ্যুৎ বন্ধ করুন।
⇨ পানি ব্যবহার করবেন না। পানি বিদ্যুৎ পরিবহন করে, যা জীবনহানির কারণ হতে পারে।
⇨ বেকিং সোডা ব্যবহার করুন। এটি আগুনের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দ্রুত নেভায়।
⇨ সঠিক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করুন। ‘সি’ বা ‘এবিসি’ ক্যাটাগরির যন্ত্র বিদ্যুৎ-সংশ্লিষ্ট আগুন নেভাতে ব্যবহারযোগ্য।
যদি আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, দ্রুত পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদ স্থান খুঁজে সরিয়ে নিন। ধোঁয়া ও তাপের কারণে শ্বাস নিতে অসুবিধা হলে নিচে নেমে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দ্রুত বের হওয়া উচিত।
রান্নাঘরের আগুন, প্রতিরোধ ও নেভানোর পদ্ধতি-
চর্বি বা তেল অতিরিক্ত গরম হলে আগুন লাগতে পারে। বিশেষভাবে করণীয়: চুলার তাপ বন্ধ করুন। আগুনকে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন, এতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়। ঢাকনা না থাকলে বা কার্যকর না হলে বেকিং সোডা বা লবণ ব্যবহার করুন। বড় আগুনের জন্য বি ক্যাটাগরির অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করুন। পানি বা পাতলা কাপড় ব্যবহার করবেন না, কারণ আগুন আরও ছড়িয়ে যেতে পারে।
কিছু মানুষ ভুলভাবে আগুনে হাত বা পাত্র ধরে দেখতে চায়। এটি করা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং হাত পুড়ে যেতে পারে। রান্নার সময় ভারী ধাতব পাত্র ব্যবহার করুন এবং খাবার তৈরির সময় অতি সতর্ক থাকুন।
ছোট সতর্কতা, বিপদ থেকে বড় রক্ষা-
বৈদ্যুতিক তারের অবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। চুলা বা গ্যাস চুলার পাশে কোনও জ্বলনযোগ্য বস্তু রাখবেন না। রান্নাঘরে থাকাকালীন অন্য কাজ করলে আগুন নজরদারির বাইরে চলে যেতে পারে। পরিবারের সবাইকে আগুনের ঝুঁকি এবং প্রাথমিক প্রতিকার শিখিয়ে রাখুন। ধোঁয়া ও আগুনের পথ বন্ধ করতে সবসময় দরজা ও জানালা ব্যবহার করুন।
আগুন ছড়িয়ে গেলে করণীয়-
☞ শান্ত থাকুন। প্যানিক করলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়।
☞ নিচ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। আগুন সাধারণত উপরের দিকে ছড়িয়ে যায়।
☞ উচ্চতায় অবস্থান করুন। যদি নিচ দিয়ে বের হওয়ার পথ বন্ধ থাকে।
☞ মুখ ঢেকে ধোঁয়া এড়িয়ে চলুন। কাপড় বা হ্যান্ডক্লথ ব্যবহার করতে পারেন।
☞ দরজা বন্ধ করে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। এটি আগুনের বিস্তার কিছুটা রোধ করে।
প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
☞ ডিটেক্টর ও অ্যালার্ম: ধোঁয়া ও গ্যাস সনাক্তকরণ ডিভাইস বাসায় থাকা উচিত।
☞ স্মোক অ্যালার্ম: ধোঁয়া বা আগুন দ্রুত শনাক্ত করে।
☞ আগ্নি নির্বাপক যন্ত্র: পরিবারের প্রতিটি প্রধান স্থানেই রাখতে হবে।
☞ নিরাপদ রান্নাঘর: তেল বা চর্বি রান্নার জন্য ভারী পাত্র ব্যবহার করুন।
☞ নিয়মিত বিদ্যুৎ পরীক্ষা: অতিরিক্ত ভোল্টেজ বা পুরনো তার আগুনের প্রধান কারণ।
বাসাবাড়ি অগ্নি নিরাপত্তার মৌলিক শিক্ষা-
◑ আগুন লাগলে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসে কল করুন।
◑ নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
◑ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে বাসা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
প্রতিটি মুহূর্তে সতর্কতা অবলম্বন করুন। ছোট অবহেলা বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
বাসাবাড়িতে আগুন শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতি নয়, মানসিক চাপ ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। তবে সতর্কতা, সঠিক প্রস্তুতি এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে বিপদের পরিমাণ কমানো সম্ভব। আগুনের প্রতি অবহেলা জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। সতর্কতা এবং সচেতন পদক্ষেপই জীবনের সেরা নিরাপত্তা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।