ধীরে বেড়ে ওঠা ফাইকাস বোনসাই,যে যত্নে তা জীবন্ত শিল্পকর্মে রূপ নেয়!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ফাইকাস বোনসাই শুধু টবের একটি ছোট গাছ নয়, এটি এক ধরনের জীবন্ত শিল্প। ক্ষুদ্রাকৃতির এই বৃক্ষটিকে সুগঠিত, দীর্ঘজীবী ও নান্দনিক করে তুলতে হলে জানতে হয় এর বৃদ্ধির গোপন রহস্য। প্রকৃতির জটিল জৈবপ্রক্রিয়া, আলো–জল–বাতাসের সূক্ষ্ম উপাদান, শিকড়ের গঠন, টাহিনের শক্তি এবং পাতার হরমোনগত প্রভাব মিলেই তৈরি হয় একটি সফল বোনসাই।
ফাইকাস গণে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বোনসাই তৈরির জন্য একে অনন্য করে:
⇨ শিকড় শক্তিশালী ও দ্রুত পুনর্গঠিত হয়।
⇨ পাতা ছোট করা যায়।
⇨ কাণ্ড মোটা হয়।
⇨ আঁকাবাঁকা স্টাইলে আকার দেওয়া সহজ।
পরিবেশের পরিবর্তনে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। এজন্যই ফাইকাস বোনসাই নবীন ও অভিজ্ঞ উভয় ধরনের পরিচর্যাকারীর পছন্দের তালিকায় থাকে।
ফাইকাসের বৃদ্ধি–গোপন রহস্য-
১) শিকড়ের বিপুল পুনর্জন্ম ক্ষমতা: ফাইকাসের মূলত শক্তিশালী অ্যাডভেন্টিভ রুট সিস্টেম থাকে। এর বৈশিষ্ট্য:
◑ কেটে দিলে সহজেই নতুন শিকড় জন্মায়।
◑ বাতাস থেকে আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে।
◑ মাটির অল্প জায়গাতেও সজীব থাকে।
◑ এ কারণেই বোনসাই টবের সঙ্কুচিত মাটিতে। ফাইকাস সহজেই টিকে যায়।
২) পাতা তৈরি নিয়ন্ত্রণ করে হরমোন: ফাইকাসের পাতায় উপস্থিত ‘অক্সিন’ হরমোন নতুন কান্ড, শাখা ও পাতার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। যখন শাখা ছাঁটা হয় তখন —
◑ অক্সিনের প্রবাহ কমে যায়।
◑ পাশের কুঁড়িগুলো জেগে ওঠে।
◑ গাছ ঝোপালো আকার ধারণ করে।
◑ বোনসাইয়ের ঘনত্ব বাড়ানোর মূল রহস্য এখানেই।
৩) কাণ্ড দ্রুত মোটা হওয়ার ক্ষমতা: ফাইকাসের ভেতরে সেকেন্ডারি গ্রোথ খুব সক্রিয়। এতে—
◑ কাণ্ড ধীরে হলেও ধারাবাহিকভাবে মোটা হয়।
◑ বোনসাইয়ের প্রাচীন–দর্শন ভঙ্গি তৈরি হয়।
অনেকেই এই গুণটি কাজে লাগিয়ে ফাইকাসকে একেবারে পুরোনো গাছের মতো রূপ দিতে পারেন।
৪) আকার দেওয়ার জন্য আদর্শ নমনীয়তা: ফাইকাসের শাখায় রবারি নমনীয়তা থাকে। ফলে—
◑ তার দিয়ে বাঁকানো সহজ
◑ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বেশি
◑ স্ট্রেস থেকে দ্রুত সেরে ওঠে
এই গুণের জন্যই ফাইকাস বোনসাই যেকোনো স্টাইলে গড়া যায়—ঝোপালো, বাকা কাণ্ড, উঁচু কান্ড বা ঝর্ণাধারার মতো ড্রপিং স্টাইল।
ফাইকাস বোনসাই দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়ে তোলার বাস্তব কৌশল-
১) আলো,পরোক্ষ তীব্র আলোই সেরা! ফাইকাস আলো ভালোবাসে, কিন্তু সরাসরি প্রখর রোদ পাতা জ্বালিয়ে ফেলতে পারে। সেরা পরিবেশ:
⇨ পূর্ব বা দক্ষিণমুখী জানালার কাছে।
⇨ ফিল্টার করা আলো।
⇨ বাইরে থাকলে হালকা ছায়া।
আলো না পেলে পাতা ঝরে, কাণ্ড পাতলা হয়, বৃদ্ধি মন্থর হয়।
২) পানি কম নয়, বেশিও নয়! ফাইকাস মাটির কিছুটা আর্দ্রতা পছন্দ করে। যথাযথ নিয়ম:
⇨ মাটি শুকিয়ে এলেই জল দিন।
⇨ টবে যেন পানি জমে না থাকে।
⇨ গরম ও শুষ্ক মৌসুমে জল দেওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ে।
⇨ অতিরিক্ত পানি দিলে শিকড় পচে যায়,যা বোনসাইয়ের সবচেয়ে বড় বিপদ।
৩) মাটি, বাতাস চলাচলযোগ্য মিশ্রণ! আদর্শ মাটি হলো- বালিমাটি, অরগানিক কম্পোস্ট, পার্লাইট বা ঝুরঝুরে উপাদান। মাটির পানি–নিষ্কাশন যত ভালো হবে, শিকড় তত শক্তিশালী হবে।
৪) সার, বৃদ্ধির জ্বালানি! বসন্ত–বর্ষায় ফাইকাস বেশি বাড়ে। এই সময়-
◑ নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ তরল সার।
◑ মাঝে মাঝে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট।
হরমোন বুস্টার নয়,স্বাভাবিক সারই যথেষ্ট। সার দিলে গাছ দ্রুত নতুন পাতা ও শাখা তৈরি করে।
৫) ছাঁটাই, ঘনত্ব ও আকার তৈরির শিল্প! ছাঁটাই ফাইকাস বোনসাইয়ের প্রাকৃতিক শিল্পমান বাড়ায়। নিয়ম:
⇨ বাড়তি শাখা ২–৩ পাতার ওপর রেখে কেটে দিন।
⇨ প্রতি ছাঁটাইয়ে পাশের কুঁড়ি জেগে ওঠে।
⇨ শীতকালে ছাঁটাই কম করুন।
ছাঁটাইই বোনসাইকে গাছ থেকে শিল্পকর্মে রূপ দেয়।
৬) তার বাঁধা, স্টাইল গঠনের সূক্ষ্ম কৌশল! প্রথমেই তার ঢিলে করে লাগান। ৪৫ ডিগ্রি কোণে প্যাঁচ দিন। প্রতি দুই সপ্তাহে দেখে নিন তার গাছের গায়ে ঢুকে যাচ্ছে কি না। ফাইকাস দ্রুত বাড়ে, তাই তার ঢুকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭) repotting, শিকড় সুস্থ রাখার জরুরি ধাপ! প্রতি ১.৫–২ বছরে একবার টব বদলানো প্রয়োজন। এতে—
◑ শিকড় নতুন জায়গা পায়।
◑ পুষ্টি পৌঁছায়।
◑ পুরোনো জমাট মাটি সরানো যায়।
◑ টব বদলানোর পর ১–২ সপ্তাহ ছায়ায় রাখলে গাছ দ্রুত মানিয়ে নেয়।
ফাইকাস এমন একটি উদ্ভিদ যা পরিবর্তনশীল পরিবেশে অসাধারণ ভাবে টিকে থাকতে পারে। যেমন-
◑ আর্দ্রতা কম থাকলে পাতার স্তর বন্ধ করে পানি সংরক্ষণ করে।
◑ আলো কম থাকলে কান্ড লম্বা করে।
◑ বেশি আলো পেলে পাতা ছোট করে ঘনত্ব বাড়ায়।
◑ শিকড় ছেঁটে ফেললেও দ্রুত নতুন শিকড় গজায়।
এই অভিযোজন ক্ষমতাই ফাইকাসকে বোনসাই–বিশ্বে অপরাজেয় করেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, সবুজ গাছের উপস্থিতি মানসিক চাপ কমায়, ঘরের বায়ু শুদ্ধ করে, মনোযোগ বাড়ায়, ঘরকে নান্দনিক করে। আর ফাইকাস বোনসাই ছোট হলেও এর প্রভাব বড়।
ফাইকাস বোনসাই তৈরি করা শুধু বাগান–চর্চা নয়, এটি সময়, ধৈর্য, বিজ্ঞান ও শিল্পের মিলিত প্রয়াস। প্রতিটি শাখা ছাঁটাই, টব বদলানো, আলো–জল–মাটির সামান্য পরিবর্তন সবকিছুই গাছকে ধীরে ধীরে রূপ দেয় এক ক্ষুদ্র জীবন্ত বনানীতে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।