সহমর্মিতার সংকটে সমাজ! নতুন সামাজিক আচরণ দেখাচ্ছে উদ্বেগজনক ইঙ্গিত!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের ইতিহাসে যুদ্ধ, সংঘাত, পারস্পরিক অবিশ্বাস বা বিভেদের চেয়ে বড় শক্তি সহমর্মিতা। মানবসভ্যতার প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি সংস্কৃতিতে একটি বিষয়ই মানুষকে একত্রে এনে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে: একজন আরেকজনের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা। এ ক্ষমতাকে বলা হয় Empathy সহমর্মিতা। এটি শুধু নৈতিক বা রোমান্টিক একটি ধারণা নয়। মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সহমর্মিতা এমন এক দক্ষতা, যা সমাজে আস্থা, সহযোগিতা ও নিরাপত্তার বোধ তৈরি করে। আমরা যখন কাউকে বুঝতে চেষ্টা করি, তার অবস্থানকে উপলব্ধি করি, তার কষ্টকে গুরুত্ব দিই তখন আমাদের মস্তিষ্কে এমন নিউরাল প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় যা শেখা, সম্পর্ক, সিদ্ধান্ত ও আচরণকে পরিবর্তন করে।
সহমর্মিতা হলো সেই ক্ষমতা যার মাধ্যমে আমরা অন্য মানুষের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারি, তার অভিজ্ঞতাকে অনুভব করতে পারি, তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারি, এবং তার প্রতি দায়িত্ববোধ অনুভব করি। সহমর্মিতা আসলে তিনটি স্তরে কাজ করে-
১) Cognitive Empathy – বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা! কেউ কী অনুভব করছে তা যুক্তি দিয়ে বোঝার ক্ষমতা। যেমন, কেউ শোকাহত হলে আমরা বুঝতে পারি কেন সে এমন আচরণ করছে।
২) Emotional Empathy – অনুভব করার ক্ষমতা! অন্যের অনুভূতি ভিতরে প্রতিফলিত হওয়া। যেমন কারও কান্না দেখলে আমাদেরও আবেগ ভারী হয়ে যাওয়া।
৩) Compassionate Empathy – সহানুসঙ্গী পদক্ষেপ। এ পর্যায়ে আমরা শুধু অনুভব করি না-সাহায্যের ইচ্ছা জন্মায়। অর্থাৎ বোঝা, অনুভব করা, সাহায্য করা—এই তিনের সমন্বয়। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং মানবিকতা তিনটিই এই সহমর্মিতার ওপর দাঁড়িয়ে।
বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ কিছু নিউরন আছে, যাদের বলা হয় Mirror Neurons। এরা অন্যের আচরণ, ব্যথা বা আনন্দ দেখে আমাদের মস্তিষ্কে একই ধরনের সংকেত তৈরি করে। যেমন:
কেউ আহত হলে তার জায়গায় ব্যথা অনুভব করা, কেউ আনন্দে হাসলে নিজের মন ভালো হয়ে যাওয়া, কেউ উদ্বিগ্ন হলে নিজেও অস্থির হয়ে পড়া- এগুলো কেবল আবেগ নয়, এগুলো মস্তিষ্কের জৈবিক প্রতিক্রিয়া। কার্যকর এলাকায় রয়েছে:
⇨ Anterior Insula – আবেগ ধারণ করে
⇨ Anterior Cingulate Cortex – ব্যথা শনাক্ত করে
⇨ Prefrontal Cortex – সিদ্ধান্ত নেয় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে
এ কারণে সহমর্মিতা শুধু অনুভূতি নয়; এটি জৈবিক, নৈতিক ও সামাজিক তিন দিকেই কার্যকর।
সমাজে সহমর্মিতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
⇨ সামাজিক স্থিতি ও আস্থা বাড়ায়।যে সমাজে মানুষ পরস্পরকে বোঝে, সেখানে সংঘাত কম হয়। বিশ্বাস বাড়ে, সহযোগিতা বাড়ে।
⇨ পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। বাচ্চা–বড় সবার মধ্যেই বোঝাপড়া তৈরি হয়, সম্পর্ক দৃঢ় হয়। দাম্পত্য সম্পর্কেও সহমর্মিতা একটি মূল স্তম্ভ।
⇨ কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি করে। সহকর্মী, ম্যানেজার, টিম সব জায়গায় সমঝোতা সহজ হয়। কাজের পরিবেশে সহমর্মিতা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
⇨ মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে। অবজ্ঞা, প্রতিযোগিতা, বিচ্ছিন্নতা এগুলো মানসিক চাপ বাড়ায়। সহমর্মিতা মানসিক নিরাপত্তা তৈরি করে।
⇨ সামাজিক বৈষম্য কমাতে সহমর্মিতা কার্যকর! যেহেতু এটি অন্যের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করে, তাই সমাজে ঘৃণা, পক্ষপাত, বৈষম্য কমাতে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ডিজিটাল যুগে মানুষ আরও সংযুক্ত কিন্তু আবেগের সংযোগ কমছে। বহু গবেষণা দেখায় যে স্ক্রিন-নির্ভরতা, দ্রুতগতির জীবন, প্রতিযোগিতা ও কর্মচাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পরিবারে সময় কম দেওয়া এসব কারণে মানুষের Empathy Skill কমে যাচ্ছে। ফলে:
⇨ ছোট ভুলে সম্পর্ক ভেঙে যায়।
⇨ সামাজিক বিভাজন বাড়ে।
⇨ মতভেদে সহিংসতা বাড়ে।
⇨ শ্রদ্ধা বা সহানুভূতির জায়গায় তর্ক–প্রতিযুক্তি দখল নেয়।
সহমর্মিতার অভাব আমাদের সমাজে অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করছে, যা ধীরে ধীরে বড় সংকটে পরিণত হয়।
সহমর্মিতা কীভাবে তৈরি হয়?
◑ শৈশব-শিশু তার চারপাশের মানুষদের দেখে সহমর্মিতা শেখে। যদি অভিভাবকরা একে অপরকে সম্মান দেন, অনুভূতিকে গুরুত্ব দেন, বাচ্চার কথা শোনেন, ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখেন। তাহলে শিশুর মস্তিষ্কে সহমর্মিতা গড়ে ওঠে।
◑ teenage সময় ব্যক্তিত্ব গঠনের মাঝেই সহমর্মিতা গভীর হয়। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং প্রথম সামাজিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
◑ প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে, সময় অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, সম্পর্ক, দায়িত্ব সব মিলিয়ে Empathy আরও গভীর হয়। মানুষ শেখে, মানুষের প্রতিটি আচরণের পেছনে থাকে একটি গল্প।
সহমর্মিতা বিকাশে বাধা, কেন অনেকের Empathy কম?
মানুষ জন্মগতভাবে সহমর্মী হলেও কিছু কারণে এই অনুভূতি কমে যায়:
⇨ দীর্ঘ মানসিক চাপ
⇨ শৈশবের অবহেলা বা সহিংসতা।
⇨ নিজের আবেগ চেনার অক্ষমতা।
⇨ অতিরিক্ত ব্যস্ততা।
⇨ একাকিত্ব।
⇨ পরিবারে কঠোর পরিবেশ।
⇨ দ্রুত রাগ ওঠা।
⇨ সবসময় নিজেকে কেন্দ্র করে ভাবা।
এসব কারণ মানুষকে আবেগগতভাবে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে সে অন্যের অনুভূতি ‘দেখে’ ঠিকই, কিন্তু ‘বোঝে’ না।
সহমর্মিতা বৃদ্ধির কৌশল:
১) সক্রিয়ভাবে শোনা (Active Listening): কেউ কিছু বললে উত্তর দেব কী, এটা ভাবার বদলে আগে বুঝতে হবে সে কী অনুভব করছে।
২) নিজের মতের বাইরে গিয়ে অন্যের জায়গায় দাঁড়ানো! এটি Cognitive Empathy-এর মূল ভিত্তি। নিজের মতামতকে সাময়িকভাবে পাশে রেখে ভাবা— “তার অবস্থায় থাকলে আমি কেমন অনুভব করতাম?”
৩) ধৈর্য গড়ে তোলা। রেগে গেলে সহমর্মিতা কাজ করে না। ধৈর্য আবেগকে শীতল রাখে।
৪) ছোট ছোট মানবিক কাজ করা। যেমন- সাহায্য করা, প্রশংসা করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দৈনন্দিন আচরণকে নরম করে।
৫) পরিবারের সাথে সময় কাটানো। পরিবার সহমর্মিতা শেখানোর সবচেয়ে বড় স্কুল।
৬) বই পড়া, মানুষের অভিজ্ঞতা জানা। অন্যের জীবনের গল্প জানতে পারলে দৃষ্টিভঙ্গি বড় হয়।
৭) মননশীলতা (Mindfulness)- নিজের আবেগ বোঝা, অন্যের আবেগ বোঝার প্রথম ধাপ।
ডিজিটাল যুগ কি মানুষের অনুভূতি কমিয়ে দিচ্ছে?
ডিজিটাল সময়ে যোগাযোগ বাড়ছে, কিন্তু অনুভূতির সংযোগ কমছে -এ নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। কারণ, অনলাইনে মানুষের প্রতিক্রিয়া আবেগহীন, মেসেজে টোন বোঝা কঠিন, দ্রুত উত্তর দেওয়ার চাপ, স্ক্রিন-নির্ভর আচরণ। ফলে সহমর্মিতা কার্যত ছোট হয়ে যায়। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানবিক গল্প শেয়ারিং, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, যা Empathy তৈরি করতে সাহায্য করে।
সমাজে সহমর্মিতা থাকলে -
১) পারিবারিক সম্পর্ক টিকে যায়। একজন অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিলে ঝগড়া কমে।
২) কর্মক্ষেত্রে চাপ কমে। সহমর্মিতাপূর্ণ নেতৃত্ব কর্মীদের ভালোভাবে বোঝে।
৩) সামাজিক বিভাজন কমে। ভিন্ন মতামত গ্রহণ করতে সক্ষম হয় মানুষ।
৪) সহিংসতা কমে। সহমর্মিতা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়।
৫) মানসিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। মানুষ মনে করে “আমাকে কেউ বোঝে, আমার কথা কেউ শুনছে।” একজন মানুষের সহমর্মিতা তাই সমাজের পরিবেশকে নীরবে বদলে দেয়।
Empathy কোনো বিলাসিতা নয়, এটি সামাজিক টিকে থাকার অন্যতম ভিত্তি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীরতা, সংস্কৃতির পরিপক্বতা, সমাজের নিরাপত্তা সবকিছুই সহমর্মিতার ওপর দাঁড়িয়ে। আমরা যত সহমর্মী হব পরিবার তত শান্তিপূর্ণ হবে, সমাজ তত মানবিক হবে, কর্মক্ষেত্র তত সহযোগিতাপূর্ণ হবে, এবং মানুষের মন আরও নিরাপদ হবে। সহমর্মিতা বিকাশ মানে কারও প্রতি দয়া দেখানো নয়; এ মানে মানুষকে মানুষের মতো দেখা, তার কষ্টকে অনুভব করা, তার গল্পকে বোঝা। সহমর্মিতার উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা যে পৃথিবী গড়ে তুলি, সেটি হয় একটু বেশি মানবিক, একটু বেশি নিরাপদ, আর অনেক বেশি সুন্দর।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।