অতীতের ব্যথা কি সত্যিই মুছে ফেলা সম্ভব?-জাপানের নিউরোসায়েন্স ল্যাবে ধরা পড়ল থেরাপির এক ভবিষ্যৎচিত্র!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানবমস্তিষ্কের জটিলতা আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে বরাবরই এক গভীর রহস্য। প্রতিটি স্মৃতি সুখের হোক কিংবা বেদনার, মস্তিষ্কের স্নায়বিক সংযোগে অসংখ্য অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়। কিন্তু যেসব স্মৃতি বেদনাদায়ক, ভয়াবহ এবং জীবন–বদলে দেওয়া আঘাত হিসেবে মানুষের মনে গেঁথে থাকে, সেগুলো প্রায়শই হয়ে ওঠে মানসিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে কঠিন বাধা। পোস্ট–ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), ভয়াবহ দুর্ঘটনা, সহিংসতার অভিজ্ঞতা, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক আঘাত এগুলো শুধুই স্মৃতি নয়; এগুলো মানুষের স্বাভাবিক আচরণ, অনুভূতি এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়াকেও বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। এমন বাস্তবতার মাঝে জাপানের একদল গবেষক এমন একটি পদ্ধতির সন্ধান দিয়েছেন, যা নির্দিষ্ট ট্রমাজনিত স্মৃতি দুর্বল করতে বা কার্যত মুছে ফেলতে সক্ষম। মানবমস্তিষ্কের স্নায়বিক সার্কিট কীভাবে কাজ করে, স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়, আর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা কোন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে—এই মৌলিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই গবেষণা এগিয়েছে। এই আবিষ্কার মানব–স্নায়ুবিজ্ঞানকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এর সঙ্গে উঠে এসেছে নৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং পরিচয়–সংকট সম্পর্কিত
মানুষের স্মৃতি মূলত নিউরনের সাইনাপটিক সংযোগের মাধ্যমে গঠিত, যা পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির প্রভাবে আরও শক্তিশালী বা দুর্বল হয়।
ট্রমাজনিত স্মৃতির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় ঘটে-
১) মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা দ্রুত সক্রিয় হয়ে যায়।
২) হিপোক্যাম্পাস সেই তথ্য দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে গেঁথে ফেলে।
৩) শরীরের হরমোন–প্রতিক্রিয়া (কর্টিসল, অ্যাড্রেনালিন) স্মৃতিটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ফলে বেদনাদায়ক ঘটনা সময়ের ব্যবধানে ভুলে যাওয়ার বদলে অনেক সময় আরও গভীরভাবে মনে গেঁথে থাকে। PTSD–তে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্ষুদ্র একটি শব্দ, আলো, গন্ধ বা পরিস্থিতি দেখেই সেই ভয়াবহ ঘটনার অনুভূতিতে আবার ফিরে যায়।
জাপানি গবেষকরা মানবমস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্নায়বিক সার্কিটকে লক্ষ্য করে এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যা ট্রমাজনিত স্মৃতির সাইনাপটিক সংযোগ দুর্বল করতে পারে। স্মৃতিকে পুরোপুরি মুছে ফেলা- এই ব্যাপারটি সরলীকৃত শোনালেও আসলে এতে হয় স্মৃতি–সংযোগের পুনর্গঠন।
গবেষণার মূল প্রক্রিয়া তিন ধাপে কাজ করে-
১) স্মৃতি সক্রিয় করা: নির্দিষ্ট ট্রমাজনিত স্মৃতি মস্তিষ্কে জাগিয়ে তোলা হয়, যাতে সেই স্মৃতির স্নায়ু–পথ সক্রিয় হয়।
২) সাইনাপটিক সংযোগ দুর্বল করা: উদ্ভাবিত পদ্ধতি নিউরনের সাইনাপটিক বন্ধনকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যা স্মৃতির আবেগগত প্রভাবকে কমিয়ে দেয়।
৩) পুনর্গঠনের সময় স্মৃতি–সংশোধন: এই পর্যায়ে স্মৃতি নতুনভাবে গঠিত হয়—অর্থাৎ সেই স্মৃতির তীব্রতা, ভয় বা যন্ত্রণা অনেকটাই হ্রাস পায়। ফলে মানুষ যদিও ঘটনাটি মনে রাখে, তবুও সেই ঘটনার “আবেগগত দংশন” অনেকটাই কমে যায়। এই পদ্ধতি কার্যত স্মৃতিকে দুর্বল করা, ভয়ংকর আবেগ কমানো এবং ট্রমা–উদ্দীপিত প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ এই তিন উদ্দেশ্যেই কাজ করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, PTSD–এর চিকিৎসায়ই নতুন সম্ভাবনা! দীর্ঘদিন ধরে PTSD–এর চিকিৎসা থেরাপি ও ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি দেয়।
নতুন পদ্ধতি সরাসরি স্মৃতির স্নায়ুতন্ত্রে কাজ করায় এর পরিবর্তন আরও স্থায়ী হতে পারে। যারা দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সহিংসতার অভিজ্ঞতা বা যুদ্ধ–পরবর্তী মানসিক চাপের শিকার, তাদের জন্য এটি হতে পারে জীবন বদলে দেওয়ার সমাধান।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে মস্তিষ্ক–পরিবর্তনের নতুন দিগন্ত। মস্তিষ্কের সাইনাপস পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট স্মৃতিকে দুর্বল করা। এটা আগে কেবল গবেষণামূলক ধারণা ছিল। এখন বাস্তব পরীক্ষায় সফল হওয়ায় নতুন উৎসাহ তৈরি হয়েছে।
মানসিক আঘাত কমলে আচরণগত উন্নতি ঘটে। বেদনাদায়ক স্মৃতির তীব্রতা কমলে মানুষ সামাজিকভাবে আরও স্বাভাবিক হতে পারে। ভয়, দুঃস্বপ্ন, ঘাম, আতঙ্ক—এসব উপসর্গও কমতে পারে।
স্মৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ শোনায় যতটা উত্তেজনাপূর্ণ, ততটাই জটিল।
১) স্মৃতি কি আমাদের পরিচয় নয়? মানুষের অভিজ্ঞতা-ভালো, খারাপ, ভয়াবহ-সবকিছু মিলিয়েই গড়ে ওঠে একটি ব্যক্তিত্ব। যদি স্মৃতি পরিবর্তন করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কি মানুষের চরিত্র–পরিচয় বিকৃত হবে?
২) ভুল স্মৃতি দুর্বল করা-নাকি প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তাও মুছে যাবে? বেদনাদায়ক স্মৃতিও আমাদের শিখিয়ে দেয় কোন পরিস্থিতি এড়াতে হবে। সেগুলো কমে গেলে কি মানুষ বিপজ্জনক আচরণের দিকে যাবে?
৩) প্রযুক্তির অপব্যবহার কি সম্ভব? যদি কেউ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অপরাধ, শোক বা ব্যর্থতার স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়? সমাজ ও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বড় প্রশ্ন।
৪) সম্মতি ও ব্যক্তি–অধিকার। কেউ নিজের স্মৃতি পরিবর্তন করতে চাইলে কি সবসময় তা নৈতিক হবে? অন্য কেউ কি কারও স্মৃতি দুর্বল করার চেষ্টা করবে?
বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, বিজ্ঞান যত শক্তিশালী হচ্ছে, নৈতিকতার প্রয়োজন তত বাড়ছে।
গবেষকরা জানান, পরীক্ষায় ট্রমাজনিত স্মৃতির প্রতিক্রিয়া কিছুটা কমে গেছে। অংশগ্রহণকারীরা আগের মতো শারীরিক আতঙ্কজনিত সাড়া দেখায়নি। স্মৃতি পুরোপুরি মুছে যায়নি, তবে তার ‘আবেগগত তীব্রতা’ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
তবে এটিও সত্য যে, গবেষণা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। দীর্ঘমেয়াদি ফল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা!
মানবমস্তিষ্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে-
১) স্মৃতি–পরিবর্তন যদি ভুলভাবে প্রয়োগ হয়, তা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
২) অতিরিক্ত পরিবর্তন মানুষের ব্যক্তিত্বে অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে।
৩) সামাজিকভাবে এটি মূল্যবোধ–নৈতিকতার বড় সংকট তৈরি করতে পারে।
৪) পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তাই তারা গবেষণার অগ্রযাত্রা নিয়ে উৎসাহিত হলেও অত্যন্ত সতর্ক।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, সঠিক নৈতিক কাঠামো ও নিরাপদ পদ্ধতির মাধ্যমে একদিন এই প্রযুক্তি উন্নত ট্রমা–চিকিৎসার নির্ভরযোগ্যআ উপায় হয়ে উঠতে পারে। তবে এটি কখনোই স্মৃতি মুছে দেওয়া নামে সীমাহীন ক্ষমতাসম্পন্ন হাতিয়ার হওয়া উচিত নয়। সম্ভবত ভবিষ্যতে চিকিৎসা–বিজ্ঞান এমন জায়গায় পৌঁছাবে যেখানে, মানুষ ভয়ংকর স্মৃতি ভুলবে না, তবে সেই স্মৃতির দংশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।ক্রমশ এগোবে এমন প্রযুক্তি যা মানুষের মানসিক আঘাত হ্রাস করবে, কিন্তু পরিচয় বা ভাবনার স্বাধীনতাকে নষ্ট করবে না।
জাপানের গবেষণা নিঃসন্দেহে মানব–স্নায়ুবিজ্ঞানে এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। ট্রমাজনিত স্মৃতি দুর্বল করার সম্ভাবনা একদিকে যেমন মানসিক আঘাতে ভোগা মানুষের জন্য আশার আলো, অন্যদিকে এটি নৈতিক প্রশ্নে ভরপুর এক জটিল ক্ষেত্র। স্মৃতি শুধু তথ্য নয়, এটি অনুভূতি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিত্ব ও মানুষ হওয়ার পূর্ণতা। তাই স্মৃতি নিয়ন্ত্রণের যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারে যেমন সতর্কতা জরুরি, তেমনই প্রয়োজন গভীর মানবিক বিবেচনা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।