নিঃশব্দে বাড়ছে অবসাদ, ভেঙে যাচ্ছে পরিবার-বন্ধ্যত্ব কি সত্যিই আজকের সমাজের মহামারি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বন্ধ্যত্ব, শব্দটি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে ছিল এক অস্বস্তিকর নীরবতা। চিকিৎসা, পরিবার, সম্পর্ক, মানসিক চাপ সবকিছুকে একসঙ্গে স্পর্শ করে এমন জটিল বাস্তবতা। আজ মেডিক্যাল সায়েন্স যত উন্নত হচ্ছে, ততই পরিষ্কার হচ্ছে যে বন্ধ্যত্ব কোনো ব্যতিক্রম নয়; বরং বিভিন্ন শারীরিক, হরমোনজনিত, জীবনযাপন–সম্পর্কিত অথবা পরিবেশগত কারণের জটিল সমন্বয়। অথচ সামাজিক আলোচনা এখনো লজ্জা, দোষারোপ আর ভুল ধারণার আড়ালে বন্দি।
বন্ধ্যত্ব-শুধু চিকিৎসাগত সমস্যা নয়, সামাজিক চাপের নির্মম ছায়াও! বন্ধ্যত্ব বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয়, এক বছর নিয়মিত প্রচেষ্টার পরও গর্ভধারণ না হওয়া। কিন্তু এই সংজ্ঞার বাইরের বাস্তবতা আরও বিস্তৃত। সমাজে এখনো ভুলভাবে ধারণা করা হয়, সমস্যা শুধুই নারীর। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান দেখায় যে পুরুষ ও নারী উভয়ের কারণেই বন্ধ্যত্ব হতে পারে। নারীর ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, ডিম্বনালীর প্রতিবন্ধকতা বা জরায়ুর অন্যান্য জটিলতা ভূমিকা রাখতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে, স্পার্মের সংখ্যা কম হওয়া, গুণগত মানে ত্রুটি, হরমোনজনিত সমস্যা বা জীবনযাপনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য।কিন্তু বাস্তবে পরিবারে যে চাপ তৈরি হয়, তা বিশুদ্ধ চিকিৎসাগত কারণের বাইরে। অনেকে মনে করেন, বিয়ের কিছুকাল পরই সন্তান না হলে তা কোনো ব্যর্থতা। অথচ গবেষণা বলে প্রতিটি দম্পতির শারীরিক গঠন ও হরমোনের স্বাভাবিক সক্ষমতা আলাদা; কারো চক্র দ্রুত কার্যকর হয়, কারো সময় লাগে। এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে বোঝার আগে সমাজের তির্যক দৃষ্টি যে ক্ষত সৃষ্টি করে, তা অনেক গভীর। অনেক নারী বা পুরুষ নিজেরাই ভেঙে পড়েন অপরাধবোধে। বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার চাপের সঙ্গে যুক্ত হয় অবিশ্বাস, মানসিক অস্থিরতা, বিবাহে দাম্পত্য টানাপড়েন, এ যেন এক অদৃশ্য মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র।
মানব প্রজনন একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল প্রক্রিয়া। নারী ও পুরুষ উভয়ের শরীরে কয়েকটি ধাপ নিখুঁতভাবে সমন্বিত না হলে গর্ভধারণ সফল হয় না।
১) হরমোন নিঃসরণ:মস্তিষ্ক, পিটুইটারি গ্রন্থি ও প্রজনন অঙ্গগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকলে ডিম্বস্ফোটন বাধাগ্রস্ত হয়। হরমোন পরিবর্তন প্রভাবিত করে ডিমের মান, জরায়ুর আবরণ, এমনকি স্পার্ম উৎপাদনও।
২) ডিম্বস্ফোটন:নিয়মিত ডিম্বস্ফোটন না ঘটলে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ কঠিন। বিশেষত পিসিওএস বা থাইরয়েডের সমস্যা ডিম্বস্ফোটনকে বাধা দেয়।
৩) নল ব্যবস্থা:ডিম্বনালী ব্লক থাকলে ডিম ও স্পার্মের সংযোগই হয় না। এই ব্লক হতে পারে সংক্রমণ–পরবর্তী জটিলতা বা পূর্বের কোনো প্রদাহের কারণে।
স্পার্মের গঠন ও শক্তি:
যথাযথ পরিমাণ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্পার্ম না থাকলে নিষিক্তকরণ সম্ভব নয়। খাদ্যাভ্যাস, দূষণ, ধূমপান বা উচ্চ মানসিক চাপ স্পার্মের ক্ষতি করে।
জরায়ুর ভেতরের আবরণ অতিরিক্ত পুরু বা অতিরিক্ত পাতলা হলে ভ্রূণের সঠিকভাবে স্থাপন বাধাগ্রস্ত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান এগুলোকে বিশ্লেষণ করে ধাপে ধাপে কারণ নির্ণয় করে। তাই বন্ধ্যত্ব কোনো রহস্য নয়, বরং বোঝার বিষয়, শরীর তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোথায় বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
চিকিৎসকরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছেন, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বন্ধ্যত্বের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়ায়। গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে—
☞ মানসিক চাপ: উচ্চ মানসিক চাপ নারী ও পুরুষ উভয়ের হরমোন নিঃসরণে অসামঞ্জস্য তৈরি করে। কর্টিসল নামের স্ট্রেস–হরমোন শরীরের প্রজনন–প্রক্রিয়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। কাজের চাপ, পারিবারিক চাপ, সামাজিক চাপ-সব মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদে দাঁড়ায় বড় বাধা হিসেবে।
☞ খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার, উচ্চ মাত্রার চিনি, অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা ঘুম–বিরোধী অভ্যাস শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে। বিপরীতে ভিটামিন বি–কমপ্লেক্স, আয়রন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট-এসব উপাদান প্রজনন–ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
☞ পরিবেশ দূষণ: নানা গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুদূষণ ও প্লাস্টিকজাত কেমিক্যাল শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। শহুরে জীবনযাপনের এই অদৃশ্য দূষণ প্রজননক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করতে পারে।
⇨ ধূমপান ও অ্যালকোহল- এগুলো প্রজনন কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ডিম্বাণু ও স্পার্মের মান দ্রুত খারাপ করে দেয়।
⇨ ঘুম। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে হরমোনের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়, যা ডিম্বস্ফোটন বা স্পার্ম উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।
এই জীবনযাপনের পরিবর্তনগুলো হয়তো রাতারাতি ফল দেয় না, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করলে শরীর তার প্রাকৃতিক সক্ষমতা ফিরে পেতে শুরু করে।
বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার ক্ষেত্রটি বহু ধাপের সমন্বয়। অনেকেই ভাবেন, চিকিৎসা মানেই ব্যয়বহুল বা জটিল। কিন্তু বাস্তবে চিকিৎসার প্রথম ধাপ খুবই সহজ: কারণ চিহ্নিতকরণ। শরীরের হরমোন পরীক্ষা, আলট্রাসাউন্ড, স্পার্ম বিশ্লেষণ এই সবগুলোই সাধারণ এবং নিরাপদ। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য হরমোন সমন্বয়, জীবনযাপনের উন্নতি বা নিয়ন্ত্রিত ডিম্বস্ফোটন চিকিৎসাতেই ফল আসে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি স্বাভাবিক চিকিৎসাকে আরও কার্যকর করেছে। ভ্রূণের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, জরায়ুর পরিবেশপাত পরীক্ষা, ডিম্বাণুর মান মূল্যায়ন এসবই আধুনিক চিকিৎসার অংশ। চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্যই নিশ্চিত ফলের প্রতিশ্রুতি দেয় না, কিন্তু এটি পথ দেখায়, কোন ধাপ অনুসরণ করলে সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে।
সন্তান–চাপের কারণে সমাজে যে নীরব মানসিক ট্রমা তৈরি হয়, তা গবেষণায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যারা বন্ধ্যত্ব–সংক্রান্ত চিকিৎসায় রয়েছেন, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ক্লান্তি, আত্ম–অবিশ্বাস বা হতাশায় ভোগেন। বন্ধ্যত্ব কোনো ব্যর্থতা নয়, এটি শরীরের জটিলতার একটি সমস্যা। কিন্তু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলা ভুল ব্যাখ্যার কারণে অনেকেই নিজের বিরুদ্ধে দোষারোপে ভেঙে পড়েন। এটি শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও সত্য।চিকিৎসকরা বলছেন, দম্পতির উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা বা প্রশ্ন করা শুধু মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে। পরিবার বা সমাজ একটু সচেতন হলে এই অযাচিত চাপ অনেকটাই কমানো যায়।
প্রজনন–বিজ্ঞানের আধুনিক অগ্রগতি বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। দম্পতিরা এখন অনেক বেশি তথ্য–সচেতন, এবং সমাজেও ধীরে ধীরে বদল আসছে। চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা, সামাজিক সমর্থন এবং জীবনযাপনে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এসব একসঙ্গে কাজ করলে বন্ধ্যত্ব আর কোনো অন্ধকার সংকট নয়, বরং সমাধানযোগ্য একটি সমস্যায় পরিণত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মানসিক শক্তি। গবেষণা বলছে, যেসব দম্পতি মানসিকভাবে স্থিতিশীল ও ইতিবাচক থাকেন, তাদের চিকিৎসায় সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি।
বন্ধ্যত্বকে ঘিরে সমাজে দীর্ঘদিনের ভুল ধারণা এখনো রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃঢ় অগ্রগতি, চিকিৎসার সহজলভ্যতা এবং সচেতনতার বিস্তার আজ এই সংকটকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করছে। বন্ধ্যত্ব হলো দেহের ভেতরে ঘটে যাওয়া একটি বিস্তৃত, জটিল এবং বহু–স্তরবিশিষ্ট প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত। এটি কোনো অপরাধবোধের জায়গা নয়। বরং এটি জানান দেয়, শরীর আমাদের সাহায্য চাইছে। একটু সচেতনতা, সামান্য জীবনযাপনের পরিবর্তন, চিকিৎসার সঠিক পথ ও মানসিক শক্তি সব মিলিয়েই তৈরি হয় আশার আলো। বন্ধ্যত্ব আজ আর অপ্রকাশ্য কোনো গল্প নয়; এটি হাজারো মানুষের বাস্তব সংগ্রাম, যেখানে বিজ্ঞান, সমর্থন এবং বোঝাপড়াই পথ দেখাতে পারে নতুন সম্ভাবনার দিকে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।