আছে ইতিহাসের ভার, তবুও অবহেলিত চবির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ

আছে ইতিহাসের ভার,  তবুও অবহেলিত চবির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ
  • Author, নাঈম আল আরাফ, চবি
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ধারণ করে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রথম সারির স্বায়ত্তশাসিত এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে, যাদের অনেকেই হয়েছেন শহীদ। তাদের স্মৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অমর করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মরণ চত্বর। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও এসব ইতিহাসবাহী স্থাপনার বর্তমান চিত্র হতাশাজনক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি ও হরহামেশাই এসব স্মৃতিস্তম্ভে ব্যানার, ফেস্টুন টানানোর কারণে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো হারাচ্ছে তাদের মর্যাদা ও তাৎপর্য।

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন বীরপ্রতীক শহীদ মোহাম্মদ হোসেন। যিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান ছিলেন। এছাড়াও চাকসুর সাবেক জিএস ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র শহীদ আব্দুর রব, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ উদ-দৌলা, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র শহীদ নাজিম উদ্দিন খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহীদ প্রভাষ কুমার বড়ুয়া ও আলাওল হলের নিরাপত্তা প্রহরী ছৈয়দ আহমদ নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। তাদের এই অমর কীর্তিকে ধারণ করে চবির মূল ফটকের সামনেই নির্মিত হয়েছে স্মরণ চত্বর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথের এ স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে প্রায়ই দেখা যায় ব্যানার ফেস্টুন সাটানো৷ এমনকি স্মৃতিস্তম্ভের উপরে পড়ে আছে নষ্ট এলইডি স্ক্রিন।

প্রায় একই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের। শহীদ মিনারের চারপাশের প্রায়ই দেখা যায় ঢেকে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ব্যানার। এমনকি শহীদ মিনারের ভিতরপর পানির ফোয়ারা পরিনত হয়েছে পঁচা আবর্জনা ও ময়লার ভাগাড়ে ।


শহীদ মিনারের পাশেই 'জয় বাংলা' স্মৃতিস্তম্ভ৷ স্মৃতিস্তম্ভের ‘জয় বাংলা’ লেখাটি ভেঙে ফেলার পরও তা আর মেরামত করা হয়নি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বর ও স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরালও রয়েছে অবহেলায়, অযত্নে। আছে রক্ষণাবেক্ষণেরও ঘাটতি।


মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের এসব স্মৃতিচিহ্নগুলোর অবহেলায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অর্থনীতি বিভাগ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু বায়েত সিয়াম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ধারণ করার ব্যাপার নয়, বরং লালন করারও ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভগুলো বেশিরভাগ সময়েই অপরিচ্ছন্ন,  পোস্টার, ব্যানারে জরাজীর্ণ হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে না দেয় কোনো মনোযোগ, না করে তত্বাবধান। তাদের উচিত স্মৃতিস্তম্ভগুলো যত্নের ব্যাপারে সজাগ থাকা।


এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, স্মরণ চত্বরসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করা স্থানগুলোর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চাকসুর হলেও বাস্তবে তারা নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ধারণ করে না, আর ধারণ করার সক্ষমতাও তাদের নেই। 

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থী দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের স্মরণে স্মরণ চত্বর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি যথাযথ মর্যাদা ও যত্নে সংরক্ষণ করা ছিল অত্যাবশ্যক কিন্তু সেটিও হয়নি।


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত কোন স্থানে ব্যানার টানানো যাবে আর কোন স্থানে যাবে না সেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া। পূর্ববর্তী প্রক্টরের সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থেকে এসব ব্যানার ফেস্টুন অপসারণ করা হতো, কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের চবি সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, জুলাইয়ের পর থেকে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলোর উপর নানা ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে আমরা দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাইকে মুখোমুখি দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা চত্বরের নাম ভাঙার পরেও প্রশাসন  পুনর্বহাল করেনি। জুলাই পরবর্তী প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে যথাযথ সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে৷ জুলাই পরবর্তী প্রশাসনের দলীয় পক্ষপাত এখন ওপেন সিক্রেট। এই ঘটনাগুলো তাদের মতাদর্শিক পক্ষপাতের স্বাক্ষ্য দেয়৷ মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব না।

তবে এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি চাকসুর সমাজসেবা ও পরিবেশ সম্পাদক তাহসিনা রহমান। মুঠোফোনে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।


বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ কানন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে জিরো পয়েন্টসংলগ্ন স্মরণ চত্বর আমাদের জন্য গভীরভাবে আবেগপূর্ণ একটি স্থান। একইভাবে বিজয় ’৭১, স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল, শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্বরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও গৌরবের প্রতীক। এসব স্থাপনাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সারা বছর যত্নে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব; শুধুমাত্র কোনো বিশেষ দিবসে পরিষ্কার করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি-এসব স্থাপনায় ব্যানার, ফেস্টুন বা পোস্টার টানানো থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। অতীতেও এসব বিষয়ে প্রশাসন কঠোর ছিল, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। “আমাদের কাছে যেহেতু বিষয়টি এসেছে, আগামীকালকের মধ্যেই এসব স্থাপনা থেকে সব ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করা হবে,” বলেন সহকারী প্রক্টর।


বিভিন্ন জাতীয় দিবস এলেই এসব স্মৃতিস্তম্ভ করা হয় পরিচ্ছন্ন, আশেপাশের এলাকাগুলোও করা হয় আলোকিত। পাশাপাশি ভারী সাজসজ্জায়ও থাকে স্মৃতিচিহ্নের আশপাশ। কিন্তু দিবস পালন শেষে আর যেনো খোঁজ থাকেনা ইতিহাসের বীরত্ব ধারণ করা এসব স্মৃতিচিহ্নের। শুধু বিভিন্ন দিবসেই নয় বরং সারাবছরই এসব স্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণের দাবি সংশ্লিষ্টদের। 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ