চাপের ভারে ক্লান্ত শিক্ষকেরা, শিক্ষাব্যবস্থার অদেখা সংকট কি আরও গভীর হচ্ছে!

চাপের ভারে ক্লান্ত শিক্ষকেরা, শিক্ষাব্যবস্থার অদেখা সংকট কি আরও গভীর হচ্ছে!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

যখন একটি শ্রেণিকক্ষে শিশুরা তাদের স্বপ্নের প্রথম রঙ বেছে নিতে শেখে, সেই রঙগুলো বুলিয়ে দেন শিক্ষকরা। সমাজের সবচেয়ে ভরসার জায়গা শিক্ষার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাঁধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে মানুষটি দায়িত্ব নেন নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে, তিনি নিজে কতটা সুস্থ, কতটা শান্ত, কতটা প্রস্তুত?বিশ্বজুড়ে গবেষণা বলছে, মানসিক চাপ, বার্নআউট, দীর্ঘক্ষণ কাজ, কম স্বীকৃতি, প্রশাসনিক চাপ, সামাজিক প্রত্যাশা এবং শিক্ষার্থীর আচরণগত চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি সব মিলিয়ে শিক্ষকতা এখন অন্যতম চাপপূর্ণ পেশা। তবু এই চাপের গল্প সমাজে তেমন আলোচনায় আসে না। কারণ শিক্ষকরা অভ্যস্ত, সব সহ্য করে যাওয়ায়।

শিক্ষকের মানসিক চাপে আগুন লাগানোর মূল কারণগুলো -

অনেকেই মনে করেন শিক্ষক মানে দিনে কয়েক ঘণ্টা ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফেরা। বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। পাঠ প্রস্তুতি, কুইজ-পরীক্ষা নেওয়া, কপি মূল্যায়ন,শিক্ষার্থী–অভিভাবক–প্রশাসনের চাপ- মিলিয়ে প্রতি দিনের কাজ প্রায় ১০–১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। অনেক শিক্ষক বলেন, “সময় নেই”, “নিজের জীবন নেই”—এই কথাই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। আবার শিক্ষার্থীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ, মনোযোগের অভাব, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমে বাচ্চাদের আচরণগত পরিবর্তন এই সবই শিক্ষকদের ওপর নতুন মানসিক চাপ তৈরি করছে। এটিকে মনোবিজ্ঞানীরা Behavioral Fatigue বলেন, যেখানে শিক্ষক ক্রমাগত মানসিক প্রস্তুতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

সমাজ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশা করে এসেছে তিনি সব জানবেন, সব পারবেন, সব সামলাবেন। এই প্রত্যাশার চাপ ধীরে ধীরে মানসিক ক্লান্তি তৈরি করে।

অধিকাংশ দেশে শিক্ষকতা আর আগের মতো উচ্চ মর্যাদার পেশা হিসেবে দেখা হয় না।
পরিশ্রম ও শ্রমের পরিমাণ বাড়লেও স্বীকৃতি ও সম্মান কমে গেছে। এই “invisible work load” হল সবচেয়ে বড় মানসিক চাপের উৎস।

বিভিন্ন রিপোর্টিং, দাপ্তরিক নথি, ডাটা আপডেট, রুটিন তৈরি এসব কাজ এত বেশি বেড়েছে যে অনেক শিক্ষক অভিযোগ করেন, “শিক্ষাদানের চেয়ে ফাইল পূরণেই বেশি সময় চলে যায়।”

ক্লাসের ছোট ভুলও কখনো কখনো অভিভাবকের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়।
এর ফলে শিক্ষকের ওপর তৈরি হয় মানসিক অস্বস্তি।

এতকিছুর পরও অনেক দেশে শিক্ষকতা তুলনামূলক কম বেতনের পেশা।
অর্থনৈতিক চাপ মানসিক চাপকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

 

চাপের প্রভাব: 

১. Burnout Syndrome: দীর্ঘদিন চাপের ফলে শিক্ষকরা ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদে পড়ে যান। তাদের মধ্যে দেখা যায় অতিরিক্ত ক্লান্তি, কাজের প্রতি অনাগ্রহ, আবেগগত সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া, রুটিন কাজ ভুলে যাওয়া।

২. উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা: রাতেও পরীক্ষার খাতা, পরের দিনের লেসন প্ল্যান, শিক্ষার্থীর সমস্যা—এসব নিয়ে ভাবতে থাকেন শিক্ষকরা। ফলে ঘুম কমে যায়, শরীর ভেঙে পড়ে।

৩. শারীরিক অসুস্থতা: মানসিক চাপ শরীরে প্রভাব ফেলে মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, পিঠে ব্যথা, হজমের সমস্যা- এই সব খুব সাধারণ কিন্তু অবহেলিত সমস্যা।

৪. প্রফেশনাল আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া। যখন শিক্ষক নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন— “আমি কি ঠিক করছি?” তখন ধীরে ধীরে তৈরি হয় আত্মবিশ্বাসের সংকট।

 

শ্রেণিকক্ষের ভেতরে চাপের বাস্তব চিত্র!

একটি ক্লাসঘরে প্রতিদিন ৩০–৫০ জন শিক্ষার্থী। তাদের সবার শেখার ক্ষমতা, আচরণ, মানসিকতা আলাদা। এই বৈচিত্র্য সামাল দিতে গিয়ে শিক্ষক মানসিকভাবে খরচ হন সবচেয়ে বেশি। কখনো কোনো শিক্ষার্থী মনোযোগ হারায়, কেউ ক্লাসে অস্থির, কেউ সমস্যায় ভুগছে। আর শিক্ষককে একই সঙ্গে সব সামলাতে হয়। এই অবস্থায় শিক্ষাদান শুধু পাঠ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিক্ষককে হতে হয় কাউন্সেলর, গাইড, সমর্থন ও অনুপ্রেরণার উৎস।

শিক্ষকের নিজের পরিবারও চাপের অংশীদার হয়। অনেক শিক্ষক বলেন—“বাড়ি ফিরেও অফিসের কাজ শেষ করতে হয়।” এর মানে  পরিবারের সঙ্গে কম সময়, বিশ্রামের অভাব, মানসিক ক্লান্তি আরও বাড়া। শিক্ষকরা নিজেদের সন্তানকে সময় দিতে না পারার অপরাধবোধেও ভোগেন। এটিও মানসিক চাপের আরেক রূপ।

 

সমাধান: কীভাবে কমানো যেতে পারে শিক্ষকের মানসিক চাপ?

১. শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ: নিয়মিত পেশাগত প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের ক্লাসরুম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।

২. কাজের ভার সুষম করা: দাপ্তরিক কাজ কমিয়ে শিক্ষাদানে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট: স্কুলে মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ বা কাউন্সেলিং সেবা রাখা জরুরি।

৪. প্রযুক্তির ব্যবহার: ডিজিটাল টুল ব্যবহার করলে কাজ দ্রুত হয়, রিপোর্টিং সহজ হয়
এবং সময়ও বাঁচে।

৫. অভিভাবক–শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন: পরস্পরের প্রতি সম্মান বাড়ালে ভুল বোঝাবুঝি কমবে।

৬. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও Self-Care: শিক্ষকদের প্রতিদিন নিজের জন্য কিছু সময় রাখা উচিত, পাঠদানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ নিজের মানসিক স্বাস্থ্য।

 

শিক্ষকেরাই সমাজের চালিকাশক্তি। তাদের মানসিক চাপ শুধুই ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক সংকট। যদি শিক্ষক ক্লান্ত হন, বিষণ্ন হন, বার্নআউট হন, তবে তার প্রভাব সরাসরি পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর, সমাজের ওপর, ভবিষ্যতের ওপর। তাই এখনই সময়  শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া,তাদের প্রশাসনিক ভার কমানো,তাদের  শ্রদ্ধা, স্বীকৃতি ও সহায়তা বাড়ানো। একটি জাতি তখনই এগিয়ে যায় যখন তার শিক্ষকরা সুস্থ, সম্মানিত এবং মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন। শিক্ষকের মানসিক চাপ কমানো মানে, একটি জাতির ভবিষ্যৎকে আরও সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং মানবিক করে তোলা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ