পবিত্র জিলহজ্বের দশ দিন- ইবাদতের সোনালি সুযোগ ও প্রস্তুতির বাস্তব চিত্র

পবিত্র জিলহজ্বের দশ দিন- ইবাদতের সোনালি সুযোগ ও প্রস্তুতির বাস্তব চিত্র
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পবিত্র জিলহজ্ব মাস মুসলমানদের জীবনে এক বিরল গৌরবময় সময়। বিশেষ করে এর প্রথম দশ দিনকে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে 'সবচেয়ে বরকতময় ও মহিমান্বিত দিন' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের হৃদয়ে ঈমান আছে, তাদের কাছে এই দশ দিন আত্মিক পরিবর্তনের এক অনন্য সুযোগ।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে ফযীলত

১। আল্লাহর শপথ: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেছেন— "শপথ ফজরের এবং দশ রজনীর" (সূরা ফজর: আয়াত ১-২)।
তাফসীরবিদদের ব্যাখ্যায় এই দশ রজনী হলো জিলহজ্বের প্রথম দশ দিন। শপথের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা এসব দিনের মাহাত্ম্যকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন।
 

২।  সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন: ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
'এমন কোন দিন নেই যার আমল যিলহজ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোন কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।'  (আবূ দাউদ : ২৪৩৮; তিরমিযী : ৭৫৭।)
 

৩। আরাফা দিবসের মর্যাদা:এ  বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

صِيَامُ يَوْمُ عَرَفَةٍ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِيْ بَعْدَهُ

আরাফার দিনের সওম সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তা বিগত একবছর ও আগামী একবছর (এ দুই বছর)'র পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। (মুসলিম : ১১৬২)
 

৪। যিকির ও তাসবীহের মর্যাদা: 'লাতায়িফুল মা'আরিফ' গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই দশ দিনে পাঠ করা তাসবীহ, তাহলীল ও যিকির অন্যান্য দিনের নফল রোযার চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন।

 

➤  আত্মশুদ্ধির জন্য প্রস্তুতির বাস্তব পথনির্দেশ

একজন মুমিনের উচিত জিলহজ্ব মাসকে সর্বোচ্চ ফায়দা তোলার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া। এজন্য আলেমগণ ও ইসলামিক স্কলাররা যেসব সুপারিশ করেছেন তা হলো:

☞ আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা: অধিক দোয়া করা যেন তিনি আমাদেরকে এই দিনগুলিকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দেন।

☞ ক্বাযা নামায ও তওবা: পূর্বের বাকি নামায গুলো আদায় করা এবং গুনাহ থেকে খাঁটি তওবা করা, যেন এই দশ দিনের বরকত থেকে বঞ্চিত না হই।

☞ কুরআন ও যিকিরে মনোযোগ বৃদ্ধি: প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াতের সময় নির্ধারণ ও অন্তত ১০০০-২০০০ বার যিকিরের অভ্যাস।

☞ ইবাদতের রুটিন তৈরি: এই দশ দিনের জন্য বিশেষ রুটিন, যাতে থাকবে ইশরাক, দোহা, তাহাজ্জুদ, তওবা, হাজত প্রভৃতি নফল সালাত।

☞  দুরুদ ও ইস্তিগফার বৃদ্ধি: বিশেষ করে রাতে ও নির্জনে বেশি বেশি পাঠ করার অভ্যাস গড়ে তোলা।

☞ কাজ ও দুনিয়াবি ঝামেলা আগেই গুছিয়ে ফেলা: যেন এ সময়কে পূর্ণ ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা যায়।

☞ দ্বীন ও ইখলাস: জীবনের প্রতিটি কাজে "শুধু আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য" নিয়ত ঠিক করা — এটি হচ্ছে আত্মিক প্রস্তুতির সর্বোত্তম দিক।

☞  উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা

এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাববুল আলামীনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদে, বাড়ি-ঘরে, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। তবে মহিলাদের তাকবীর হবে নিম্ন স্বরে। তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপ :

اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ وَلِله الحَمْدُ.

(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ)
যিলহজ মাসের সূচনা হতে আইয়ামে তাশরীক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবীর পাঠ করা সকলের জন্য ব্যাপকভাবে মুস্তাহাব। তবে বিশেষভাবে আরাফা দিবসের ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর উক্ত তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন মাসঊদ ও আলী রা. হতে এ মতটি বর্ণিত। ইবন তাইমিয়া রহ. একে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত বলেছেন। উল্লেখ্য, যদি কোন ব্যক্তি ইহরাম বাঁধে, তবে সে তালবিয়ার সাথে মাঝে মাঝে তকবীরও পাঠ করবে। হাদীস দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত। (ইবন তাইমিয়া, মজমু' ফাতাওয়া : ২৪/২২০ )
 

সামষ্টিক উপকারিতা

এই দিনগুলো আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মিক জীবনে সৌন্দর্য ও শুদ্ধতা নিয়ে আসে। কুরবানির মতো বৃহৎ ইবাদত এ মাসে সংঘটিত হয়, যা আত্মত্যাগ ও মানবিকতা শেখায়। পাশাপাশি দরিদ্র ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়।

জিলহজ্বের প্রথম দশ দিন শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডারিক সময় নয় — এটি আত্মশুদ্ধি, ইবাদত, এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক বিশাল মওসুম। সঠিক প্রস্তুতি ও দৃঢ় নিয়ত থাকলে এই দিনগুলো হয়ে উঠতে পারে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর একটি।

"প্রত্যেক ইবাদতের পেছনে থাকে একটি নিয়ত। আর নিয়তই মানুষকে আল্লাহর প্রিয় বানিয়ে তোলে।" – একজন দ্বীনী বক্তার অভিমত।

 বিশেষ অনুরোধ: এই দশ দিনে আপনি যা কিছু করবেন, সেটি যেন হয় ইখলাসপূর্ণ এবং সুন্নাহ মোতাবেক — এটাই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।


সম্পর্কিত নিউজ