পুরুষের দায়িত্বহীনতা মনোভাবের অদলবদলেই আছে সমাধানের চাবিকাঠি

পুরুষের দায়িত্বহীনতা মনোভাবের অদলবদলেই আছে সমাধানের চাবিকাঠি
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

"পুরুষের দায়িত্বহীন মনোভাব" বলতে বোঝায় এমন একটি মানসিকতা বা আচরণ, যেখানে একজন পুরুষ নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে থাকেন। এই মনোভাবের প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ—তিন ক্ষেত্রেই নেতিবাচক হতে পারে।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুরুষের দায়িত্বহীনতা শুধু কাজের গাফিলতির নাম নয়, এটি একটি গভীর মনোভবগত সংকট। ব্যক্তি পুরুষের চিন্তা-চেতনায় লুকিয়ে থাকা এই দৃষ্টিভঙ্গিই আজ পরিবার, সম্পর্ক এবং সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করছে।

বাস্তব চিত্র ও পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও NGO Affairs Bureau-এর ২০২৩ সালের একটি যৌথ জরিপে দেখা গেছে:

১। বিবাহিত নারীদের ৫৮% মনে করেন, তাদের স্বামী ঘরের কাজে প্রায় কোনো সহযোগিতা করেন না।

২। ৪৭% নারী মনে করেন, সন্তান পালনে পুরুষ অংশগ্রহণ করেন না, শুধু আর্থিক দায়িত্বকে যথেষ্ট বলে মনে করেন।

৩। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দায়িত্বহীনতার হার বেশি হলেও, সাম্প্রতিককালে শহরেও সংখ্যাটি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
 

সমস্যার গভীরে যা রয়েছে

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মনোভাবের পেছনে কাজ করছে একাধিক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ:

১। সামাজিক মানসিকতা: "পুরুষ উপার্জন করবে, নারী ঘর সামলাবে"—এই পুরনো ধারণা এখনও অনেক পরিবারে প্রতিষ্ঠিত। এতে নারীর কাজকে গৌণ এবং পুরুষের অর্থ উপার্জনকেই 'মেইন রোল' হিসেবে দেখা হয়।

২। মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা: বহু পুরুষ নিজেদের আবেগ, ক্লান্তি কিংবা মানসিক চাপ নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। ফলস্বরূপ, তারা নিজেদের দায়িত্ব থেকে দূরে থাকেন এবং সংসারের সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়।

৩। শিশু অবস্থায় শেখানো মানসিকতা: ছোটবেলা থেকেই ছেলে শিশুদের শেখানো হয়—"তুমি মেয়ে না, রান্না ঘরের কাজ তোমার না, কান্না করা দুর্বলতা"—এমন বার্তা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

 

সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংকট সমাধানে কিছু দীর্ঘমেয়াদী ও প্রয়োগযোগ্য পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি:

১। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় পরিবারে যৌথ দায়িত্ব, লিঙ্গ-সমতা ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২। পুরুষদের কাউন্সেলিং ও সচেতনতা: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালানো দরকার। বিশেষ করে বাবা হিসেবে দায়িত্ব, সন্তানের মানসিক বিকাশে ভূমিকা—এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।

৩। মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা: নাটক, সিনেমা ও টকশোতে এমন পুরুষ চরিত্র দেখাতে হবে, যারা সহানুভূতিশীল, দায়িত্বশীল ও পরিবারে সক্রিয়। এ ধরনের 'পজিটিভ রোল মডেল' সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

একটি পরিবার কেবল অর্থনৈতিক ভিত্তিতে টিকে থাকে না; টিকে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ভাগাভাগি ও মানসিক সমর্থনের মাধ্যমে। যখন পুরুষরা কেবল উপার্জনকেই নিজের দায়িত্ব ভাবেন এবং গৃহস্থালী ও সন্তান পালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নারীর একক দায়িত্ব বলে মনে করেন, তখন সেই পরিবারের ভীত দুর্বল হয়।

আজকের সমাজে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। দায়িত্বশীল পুরুষ মানে কেবল উপার্জনকারী নয়—তিনি একজন বাবা, একজন স্বামী, একজন অংশীদার। পুরুষদের এই সমৃদ্ধ ভূমিকা গড়ে তুলতেই এখন প্রয়োজন যুগোপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকর উদ্যোগ।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর 

NGO Affairs Bureau (জরিপ)


সম্পর্কিত নিউজ