খালি পেটে লিচু খাওয়া হতে পারে মৃত্যুর কারণ!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গ্রীষ্মের আগমন মানেই বাজারে রসালো লিচুর সমারোহ। মিষ্টি স্বাদ আর মন মাতানো গন্ধের জন্য এই ফলটি ছোট-বড় সকলের কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। বাংলাদেশেও লিচুর ফলন ভালো হয় এবং এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। তবে লিচু খাওয়ার যেমন অনেক উপকারিতা রয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে এটি ক্ষতির কারণও হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিচু খেয়ে অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে, যা এই ফলটিকে নিয়ে জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
লিচুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা:
লিচু শুধু স্বাদে অতুলনীয় নয়, এটি বিভিন্ন পুষ্টিগুণেও ভরপুর। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও লিচুতে পটাশিয়াম, কপার এবং বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান।
* রোগ প্রতিরোধে সহায়ক: ভিটামিন সি শ্বেত রক্ত কণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে এবং শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
* হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: লিচুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
* হজমক্ষমতা বাড়ায়: লিচুতে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
* ত্বকের জন্য উপকারী: লিচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করতে এবং তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
* শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা করে: লিচুতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে, যা গ্রীষ্মকালে শরীরকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
লিচু খাওয়ার ক্ষতিকর দিক ও সতর্কতা:
এতসব উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও লিচু খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
* হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia): অপরিপক্ক বা কাঁচা লিচুতে হাইপোগ্লাইসিন এ এবং মিথাইলিনসাইক্লোপ্রোপাইলানিন (MCPG) নামক দুটি বিষাক্ত পদার্থ থাকে। খালি পেটে অতিরিক্ত কাঁচা লিচু খেলে শিশুদের রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত কমে যেতে পারে, যা মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সৃষ্টি করে। এর ফলে দুর্বলতা, বমি, খিঁচুনি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
* অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া: কিছু মানুষের লিচুতে অ্যালার্জি থাকতে পারে। এর ফলে ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
* অতিরিক্ত চিনি: পাকা লিচুতে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অতিরিক্ত লিচু খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে।
* কীটনাশকের ব্যবহার: লিচু চাষে অনেক সময় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ভালোভাবে না ধুয়ে লিচু খেলে শরীরে কীটনাশক প্রবেশ করতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে লিচু সংক্রান্ত দুর্ঘটনা:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে লিচু খাওয়ার পর বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে খালি পেটে অতিরিক্ত লিচু খাওয়ার ফলে অনেক শিশু অসুস্থ হয়েছে এবং কারো কারো মৃত্যুও হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে লিচু খেয়ে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যায় কমপক্ষে এক হাজার শিশু। দিনাজপুরে ২০১২ সালে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল সাতসকালে বাগানে গিয়ে লিচু খাওয়ার পর। ২০১৫ সালে একই কারণে ওই জেলাতেই ১১ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বছর কয়েক আগে ঢাকার কাছে ধামরাইয়ে একই ঘটনা ঘটে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর প্রধান কারণ হিসেবে অপরিপক্ক লিচুতে থাকা বিষাক্ত উপাদান এবং খালি পেটে খাওয়ার প্রবণতাকে দায়ী করেছেন। এসব ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং লিচু খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
করণীয়:
লিচুর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ উপভোগ করার পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকা জরুরি।
* পাকা লিচু খান: সবসময় পাকা ও পরিপক্ক লিচু খান। কাঁচা বা আধপাকা লিচু এড়িয়ে চলুন।
* খালি পেটে নয়: বিশেষ করে শিশুদের খালি পেটে লিচু খেতে দেবেন না। ভরা পেটে পরিমিত পরিমাণে লিচু খাওয়ান।
* ভালোভাবে ধুয়ে নিন: লিচু খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে নিন, যাতে কোনো প্রকার কীটনাশক বা রাসায়নিক residue না থাকে।
* অতিরিক্ত নয়: যেকোনো খাবারই অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। লিচুও পরিমিত পরিমাণে খান।
* সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ: লিচু খাওয়ার পর কোনো অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লিচু একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল। তবে সঠিক জ্ঞান ও সতর্কতা অবলম্বন করে এটি খাওয়া উচিত। সামান্য অসাবধানতা বিশেষ করে শিশুদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তাই লিচু খান, তবে সচেতন থাকুন।