মানুষ হেদায়েত পাওয়ার পর তা হারিয়ে ফেলে কেন!!

মানুষ হেদায়েত পাওয়ার পর তা হারিয়ে ফেলে কেন!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

"একদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। আজ এক ওয়াক্তও ঠিকঠাক হয় না। কুরআন হাতে নিলে বুক কেঁপে উঠত, আজ সপ্তাহ কেটে যায়—পড়ি না। সময় কোথায় গেল?"—এমন আফসোস আজ হাজারো মানুষের মুখে।

মানুষের জীবন চলমান, পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যাস বদলায়, চিন্তা পাল্টায়, ইমানও ওঠানামা করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ যে একসময় সৎ পথে চলত, দ্বীনের আলোয় জীবন গড়ত, সে কীভাবে আবার অন্ধকারে ফিরে যায়?

এই প্রশ্ন শুধু একটি মনস্তাত্ত্বিক বা দার্শনিক নয়; বরং এটি কুরআন ও হাদীসের আলোকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
 

ইসলামের ভাষ্য: হেদায়েত কি হারিয়ে যেতে পারে??

হ্যাঁ। কুরআন-হাদীস স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে, হেদায়েত একবার পেলে তা চিরস্থায়ী নয়—তাকে রক্ষা করতে হয়।

নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রতিদিন দোয়া করতেন:

"হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখো।" — (তিরমিযি, হাদীস: ৩৫২২)

এই দোয়াটি নিজেই সাক্ষ্য দেয় যে হেদায়েত একবার পাওয়া মানেই তা চিরস্থায়ী নয়। এমনকি আল্লাহর প্রিয় নবীও তা হারানোর ভয় করতেন।


হেদায়েত হারানোর মূল কারণসমূহ

১. গাফিলতি ও আত্মতুষ্টি

প্রথমে মানুষ ভালো কাজে উৎসাহী হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে আত্মতুষ্টি এসে যায়। "আমি তো ঠিকই আছি", "নামাজ-কুরআন তো করতাম", এসব চিন্তা মানুষকে আত্মতুষ্ট করে, ফলে আমল ধীরে ধীরে কমে যায়।

২. পরিবেশ ও সঙ্গদোষ

পরিবেশ ও সঙ্গ এমন একটি শক্তি, যা মানুষকে নির্মাণ করে কিংবা ধ্বংস। অসৎ সঙ্গ, অবৈধ বিনোদন, ধর্মহীন মিডিয়া, এবং নাস্তিক চিন্তাধারার প্রভাব মানুষকে দ্বীনের পথ থেকে সরিয়ে দেয়।

৩. ইলমের অভাব

জ্ঞান ছাড়া ইমান টিকে না। ইলম না থাকলে মানুষ বুঝতে পারে না কোনটি হক, কোনটি বাতিল। ফলাফল—সে বিভ্রান্ত হয়।

৪. আত্মসমালোচনার অভাব

অনেকেই প্রতিদিনের জীবন যাচাই করেন না। তাদের আমল দুর্বল হতে থাকে, কিন্তু তারা বোঝেনই না। এভাবে অজান্তেই তারা গাফিল হয়ে পড়ে।

৫. নফস ও দুনিয়ার মোহ

নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন:

"আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না, বরং আমি ভয় করি—তোমাদের জন্য দুনিয়া উন্মুক্ত হবে এবং তোমরা একে নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে।" — (বুখারি)

এই দুনিয়ার চাকচিক্য, চাকরি, টাকা, খ্যাতি—সবই এক সময় আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, যদি ইমান দুর্বল হয়।

 

বাস্তব অভিজ্ঞতা: হারানোর বেদনা

অনেকেই বলেন:

"কোনো এক সময় তাহাজ্জুদের নামাজও পড়তাম, এখন ফজরেরই সময় উঠে পারি না।"

"ইসলামি লেকচার শুনতাম, এখন গান ছাড়া চলেই না।"

"ইসলামী বই পড়তাম, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিওতেই সময় কেটে যায়।"

এগুলো কোনো গল্প নয়—আমাদের চারপাশে পরিচিত, বাস্তব চিত্র। Pew Research Center-এর মতে, ধর্মচর্চাকারী মুসলিমদের মধ্যে বড় একটি অংশ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম থেকে দূরে সরে যায়, বিশেষ করে যদি তারা ধর্মীয় শিক্ষা ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।


কীভাবে হেদায়েত ধরে রাখা যায়?

১. নিয়মিত ইলম অর্জন করা

কুরআন, সহীহ হাদীস, ইসলামি বই পড়া—জ্ঞানই হেদায়েতের টর্চলাইট।

২. সৎ সঙ্গ গ্রহণ করা

ধর্মীয় আলোচনা, দ্বীনদার বন্ধু, নেক আমল করা ব্যক্তিদের সঙ্গে সময় কাটালে ইমান জাগ্রত থাকে।

৩. আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা

ছোট হলেও নিয়মিত আমল, যেমন দৈনিক কিছু কুরআন পড়া, নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায়, ইস্তিগফার করা।

৪. দুআ করা

হেদায়েতের জন্য নবী করিম (সা.) নিয়মিত দুআ করতেন। আমরাও যেন তা নিয়মিত করি:

"হে আল্লাহ! আমাকে হেদায়েত দাও, এবং তা থেকে আমাকে বিচ্যুত করো না, আমার অন্তরকে পাক রাখো।"

৫. পরিবেশকে ঠিক রাখা

যে ঘরে, যে পরিবেশে আল্লাহর কথা হয় না, সেখানে গাফিলতি সৃষ্টি হয়। তাই ঘরেই দ্বীনের আলোচনা, কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামি আলোচনার ব্যবস্থা থাকা দরকার।


হেদায়েতের আলো যেন না নিভে যায়

হেদায়েত পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু তা ধরে রাখা দায়িত্ব এবং সংগ্রামের বিষয়। আল্লাহ বলেন: "হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।" — (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০২)

এই আয়াতই আমাদের শেষ শিক্ষা—হেদায়েত হারানোর ভয় যেন আমাদের অলসতা নয়, বরং পরিবর্তনের প্রেরণা দেয়।


সম্পর্কিত নিউজ