বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার মনোজগতের একটি অস্থির রহস্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
যখন আবেগ হয় নিয়ন্ত্রণহীন, সম্পর্ক টিকে না, আত্মপরিচয়ে সৃষ্টি হয় দ্বিধা—তখন অনেক সময় পেছনে কাজ করে একটি অচেনা মানসিক অবস্থা: বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (BPD)। ব্যক্তি বিশেষের আবেগ, চিন্তা ও আচরণে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এই জটিল ডিজঅর্ডারটি। যদিও এটি খুব পরিচিত নয়, তবে চিকিৎসা ও গবেষণার পরিধিতে এখন এটি একটি আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জটিল এই মানসিক অবস্থাটি অনেক সময় দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, অথচ এর প্রভাব হতে পারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আবেগীয় স্থিতিশীলতা এবং আত্মপরিচয়ের উপর গভীরভাবে।
কি এই বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার?
বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (BPD) হল একটি ক্রনিক ব্যক্তিত্বঘটিত মানসিক অসুস্থতা, যেখানে ব্যক্তি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, অস্থির এবং আত্ম-পরিচয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। অনেক সময় এটি আত্মহত্যার ঝুঁকির দিক থেকেও আলোচনায় আসে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলেন, এটি মূলত ব্যক্তিত্বের এমন এক ধরনের বিকৃতি যেখানে ব্যক্তি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ রাগ, ভয়াবহ শূন্যতা, পরিত্যক্ত হবার ভয় এবং নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে ভোগা—সব মিলিয়ে একটি অস্থির জীবনচক্রে পড়ে যায় ভুক্তভোগী।
এই ডিজঅর্ডার সাধারণত শুরু হয় কৈশোরের শেষ বা তরুণ বয়সে। নারীদের মধ্যে এটি বেশি পরিলক্ষিত হলেও, পুরুষদের মধ্যেও ধরা পড়ে—তবে ভিন্ন উপস্থাপনায়।
মস্তিষ্কে কি ঘটে? নিউরোবায়োলজিক্যাল প্রেক্ষাপট
BPD রোগীদের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা, হিপোক্যাম্পাস ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে কার্যকরী পরিবর্তন দেখা যায়। গবেষণায় উঠে এসেছে—
☞ অ্যামিগডালা অতিসক্রিয় হয়ে আবেগের তীব্রতা বাড়ায়
☞ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স কম সক্রিয় হওয়ায় যুক্তি ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে
☞ সেরোটোনিন ও ডোপামিন নিঃসরণে অসামঞ্জস্য দেখা যায়, যার প্রভাব পড়ে মানসিক স্থিতিশীলতায়
গভীরভাবে প্রভাবিত করে যে লক্ষণগুলো:
☞ সম্পর্কের চরমতা – হঠাৎ অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ও হঠাৎ ছিন্নতা
☞ আবেগের দ্রুত পরিবর্তন – এক মুহূর্তে হাসি, পরের মুহূর্তেই ক্ষোভ বা কান্না
☞ আত্ম-ধ্বংসাত্মক চিন্তা বা চেষ্টা – আত্মহত্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য
☞ পরিত্যক্ত হবার ভয় – অকারণে সন্দেহ, আঁকড়ে থাকা আচরণ
☞ আত্মপরিচয়ের সংকট – "আমি কে?" প্রশ্নে স্থায়ী উত্তর নেই।
☞ ইম্পালসিভ আচরণ – মাদক, বেপরোয়া চালনা, যৌনতা, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়
☞ ক্রোধের বিস্ফোরণ – ক্ষুদ্র ঘটনায় অসংগতিপূর্ণ রাগ
☞ সময় সময় বাস্তবতা বিচ্যুতি – পারানয়েড চিন্তা বা আলাদা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি
চিহ্নিত লক্ষণ ও আচরণ
বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করে:
১। সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা অথবা হঠাৎ বিচ্ছেদমুখী আচরণ
২। চরম আবেগের ওঠানামা—এক মুহূর্তে খুশি, পরক্ষণেই হতাশা
৩। "খালি" অনুভব—মনে হয় জীবন অর্থহীন
৪। বারবার আত্ম-আঘাত বা আত্মহত্যার চেষ্টা
৫। তীব্র রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
৬। বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতি বা চরম সন্দেহ
৭। ইম্পালসিভ আচরণ—হঠাৎ অর্থ অপচয়, মাদকাসক্তি, বেপরোয়া যৌনতা ইত্যাদি
উৎপত্তির কারণ: কেবল মন না, পরিবেশ ও জিনও দায়ী
⇨ জেনেটিক্স: পারিবারিক ইতিহাসে ব্যক্তিত্বঘটিত সমস্যা থাকলে ঝুঁকি বাড়ে
⇨ পরিবেশগত প্রভাব: শৈশবে অবহেলা, যৌন/মানসিক নির্যাতন, অথবা অনিরাপদ পরিবারিক পরিবেশ BPD-এর জন্ম দিতে পারে
⇨ নিউরোকেমিক্যাল বৈসাদৃশ্য: স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা যেমন সেরোটোনিন ঘাটতি আত্মনিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দেয়
চিকিৎসা: নিরাময় নয়, তবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
BPD-র কোনো "ম্যাজিক কিওর" নেই, তবে সঠিক থেরাপি ও সহায়তা রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
☞ ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT): আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে কার্যকর থেরাপি
☞ কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): নেতিবাচক চিন্তা প্রতিস্থাপন করে আচরণ সংশোধনে সহায়ক
☞ মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন: সচেতনভাবে বর্তমান মুহূর্তে মনোনিবেশ করে মন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
☞ ঔষধ: সরাসরি BPD-এর জন্য নয়, তবে সহগামী সমস্যা যেমন উদ্বেগ বা বিষণ্নতা কমাতে কিছু এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট/মুড স্ট্যাবিলাইজার ব্যবহার হয়
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: বদলাতে হবে
দুঃখজনকভাবে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কলঙ্ক ও কুসংস্কার এখনো সমাজে প্রকট।
BPD-র মতো জটিল রোগগুলোকে "নাটকবাজি", "দুর্বল মানসিকতা" বলে অবহেলা করার প্রবণতা রয়েছে। অথচ, এই ডিজঅর্ডার একটি প্রামাণ্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা যথাযথ সহানুভূতি ও চিকিৎসা ছাড়া ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং যথাযথ সহানুভূতি ছাড়া এই রোগ মোকাবেলা শুধু চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়।
পরিসংখ্যান যা ভাবায়:
⇨ বিশ্বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১.৬% এই ডিজঅর্ডারে ভোগেন (কিছু গবেষণা বলছে ৫-৬%)
⇨ আত্মহত্যা করার ঝুঁকি BPD আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১০ গুণ বেশি
⇨ ৭০-৮০% রোগীর মধ্যেই শৈশবের ট্রমার ইতিহাস পাওয়া যায়
বোঝা নয়, বোঝার প্রয়োজন
বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার মানেই জীবন শেষ নয়। বরং এটি একটি জীবনের ভেতরে তৈরি হওয়া মানসিক গণ্ডগোল, যাকে সঠিক সমাধান ও সহানুভূতির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজের দায়িত্ব হলো — "সমালোচনা নয়, সহমর্মিতার হাত বাড়ানো।"
"যখন কেউ ভেতরে লড়াই করছে, বাইরে থেকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব তাদের জীবন বাঁচাতে পারে।"
তথ্য উৎস: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA), ইউরোপিয়ান কলেজ অব নিউরোসাইকোফার্মাকোলজি (ECNP), ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রসমূহ।