প্রোস্টাটাইটিস পুরুষদেহে অগোচরে ছড়িয়ে পড়া এক জটিল স্বাস্থ্য সংকট

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রোস্টাটাইটিস—প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ—শুনতে সাধারণ, কিন্তু বাস্তবে এটি পুরুষদের দৈনন্দিন জীবন, মানসিক অবস্থা এবং যৌনস্বাস্থ্যের উপর রেখে যাচ্ছে গভীর প্রভাব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটিকে বলা হচ্ছে "underdiagnosed and over-suffered" সমস্যা।
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বহু পুরুষই ভুগছেন প্রোস্টাটাইটিস বা প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহজনিত সমস্যায়। অনেক সময় এটি সাময়িক অস্বস্তি দিলেও উপেক্ষা করলে গড়াতে পারে দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণায়। গবেষণা বলছে, ৫০ বছরের নিচে পুরুষদের প্রোস্টেট সমস্যার মধ্যে এটি অন্যতম সাধারণ – কিন্তু এটিকে ঘিরে প্রচুর ভুল ধারণা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে।
কী এই প্রোস্টাটাইটিস?
প্রোস্টেট একটি ছোট গ্রন্থি যা পুরুষদের মূত্রনালির নিচে এবং মূত্রাশয়ের সামনে অবস্থিত। এটি বীর্য উৎপাদনে সহায়ক তরল তৈরি করে এবং যৌন স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রোস্টাটাইটিস হলো প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ, যা ব্যাকটেরিয়াজনিত কিংবা নন-ব্যাকটেরিয়াল (অব্যাকটেরিয়াল) কারণেও হতে পারে। এই প্রদাহ কখনও হঠাৎ করে, আবার কখনও ধীরে ধীরে স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এটি শুধুমাত্র বয়স্কদের নয়, তরুণ পুরুষদের মধ্যেও দেখা যায়।
গবেষণা বলছে, ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যেই এই রোগটির প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি।
লক্ষণ—সবসময় স্পষ্ট নয়
প্রোস্টাটাইটিসের অন্যতম বিপজ্জনক দিক হলো এর অস্পষ্ট উপসর্গ। অনেক সময় রোগী শুধুই হালকা পেটব্যথা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা তলপেটে অস্বস্তি অনুভব করে, যা অন্য রোগের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে অনেকেই একে গুরুত্ব দেন না। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে এটি যৌনক্ষমতা হ্রাস, মানসিক চাপ ও দৈনন্দিন জীবনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রোস্টাটাইটিসের ধরন
চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রোস্টাটাইটিসকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রতিটির আলাদা উপসর্গ, গতি ও চিকিৎসা রয়েছে:
১। Acutely Infected (Acute Bacterial Prostatitis): হঠাৎ করে সংক্রমণ হয়, সঙ্গে থাকে জ্বর, কাঁপুনি, প্রস্রাবে তীব্র জ্বালা এবং তলপেটে তীব্র ব্যথা।
২। Infection (Chronic Bacterial Prostatitis): একই সংক্রমণ বারবার ফিরে আসে। অ্যান্টিবায়োটিকে সাময়িক উপশম মিললেও সমস্যা স্থায়ী হয়।
৩। Pain Without Infection (Chronic Pelvic Pain Syndrome - CPPS): সবচেয়ে সাধারণ এবং সবচেয়ে জটিল রূপ। উপসর্গ অনেক কিন্তু সংক্রমণ নেই – এটি দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কারণ।
৪। Silent Type (Asymptomatic Inflammatory Prostatitis): কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু প্রদাহ আছে – যা সাধারণত অন্য কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে।
এর পেছনে কারণ কী?
অত্যধিক সাইকেল চালানো, মূত্রনালির সংক্রমণ, মানসিক চাপ, অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ – প্রোস্টাটাইটিসের পেছনে এই সবগুলোই ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০% ক্রনিক কেসে নির্দিষ্ট সংক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, যা একে আরও গবেষণাযোগ্য করে তোলে।
কেন উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে?
অনেক পুরুষই ব্যক্তিগত বিষয় বিবেচনায় এসব উপসর্গকে গোপন রাখেন। ফলে চিকিৎসা বিলম্বিত হয় এবং রোগ জটিল রূপ নেয়। সামাজিক ট্যাবু এবং পুরুষস্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতাও বড় একটি কারণ।
প্রতিরোধ ও যত্ন: আগে ভাবুন, পরে নয়
☞ পর্যাপ্ত পানি পান
☞ সঠিক সময় প্রস্রাব করা, কখনও চেপে না রাখা
☞ যৌন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
☞ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা একটানা সাইকেল চালানো এড়ানো
☞ মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
☞ বছরে অন্তত একবার পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
প্রোস্টাটাইটিসের প্রতিকার :
☞ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ: ব্যাকটেরিয়াজনিত হলে চিকিৎসকের নির্দেশে ব্যবহার করুন।
☞ ব্যথানাশক: ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
☞ গরম স্নান: তলপেট ও মূত্রনালীর পেশী শিথিল করতে।
☞ পর্যাপ্ত পানি পান: প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি খাওয়া দরকার।
☞ হালকা ব্যায়াম ও হাঁটা: রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, পেশী মজবুত করে।
☞ দীর্ঘ সময় বসে থাকা এড়িয়ে চলা।
☞ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: তেল-মশলা কম, ফল-সবজি বেশি।
☞ মানসিক চাপ কমানো: যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন।
☞ নিয়মিত ও পরিমিত যৌন জীবন।
☞ উপসর্গ দেখলেই দ্রুত ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নিন।
এই নিয়মগুলো মানলে প্রোস্টাটাইটিসের ঝুঁকি ও সমস্যা অনেক কমে যায়।
সচেতনতা হোক প্রথম প্রতিরোধ
প্রোস্টাটাইটিস কোনো 'লজ্জার রোগ' নয়, এটি একটি সাধারণ অথচ গুরুত্বপুর্ণ পুরুষস্বাস্থ্য সমস্যা। পুরুষদের উচিত শরীরের সংকেতকে অবহেলা না করে সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা। নীরব থেকে এই সমস্যা বড় হয়ে ওঠে – সময়মতো পদক্ষেপই পারে এ থেকে মুক্তির পথ দেখাতে।
সতর্ক পুরুষই নিরাপদ – কারণ স্বাস্থ্য হচ্ছে প্রতিদিনের বিনিয়োগ, যেটির লাভ পাওয়া যায় সারা জীবন জুড়ে।