অদৃশ্য মহাবিশ্বের দুয়ার খুলে দিল জেমস ওয়েব: হাবলের সীমা পেরিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মহাবিশ্বের ইতিহাস জানার পথে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়েছে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের পরবর্তী প্রজন্মের এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়—এটি আমাদের মহাবিশ্বকে দেখার ধরনকেই আমূল পাল্টে দিয়েছে। এর ইনফ্রারেড দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জেমস ওয়েব এমন সব রহস্য উন্মোচন করছে, যা হাবল কখনও ধরতেই পারেনি।
হাবল বনাম ওয়েব: পার্থক্যের গভীরে
প্রায় তিন দশক ধরে হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের অপার সৌন্দর্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছে দৃশ্যমান ও আল্ট্রাভায়োলেট আলোয়। কিন্তু জেমস ওয়েব তার চেয়েও অনেক দূরে যেতে সক্ষম—শব্দের চেয়ে ধীর গতির, কিন্তু দূর অতীত থেকে আগত ইনফ্রারেড আলোর ফাঁকফোকর গলিয়ে।
ওয়েবের আয়না হাবলের চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বড় (৬.৫ মিটার ব্যাস), যার ফলে এটি অধিক আলো ধরতে পারে, অর্থাৎ আরও দূরের ও দুর্বল বস্তুর তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। এর ফলে ধূলিময় নেবুলা, গ্যাসীয় মেঘ এবং আমাদের চোখের আড়ালে থাকা বহু প্রাচীন গ্যালাক্সিকে স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হচ্ছে।
এই টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে, ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট-২ তে অবস্থান করছে। এখানে থেকে এটি পৃথিবীর উষ্ণতা এবং আলো থেকে দূরে থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে গবেষণা চালাচ্ছে।
ইনফ্রারেড প্রযুক্তির বৈপ্লবিক ব্যবহার
ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করার ফলে জেমস ওয়েব এমন বস্তু বা অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতে পারে যা ধূলিকণায় ঢাকা, অথবা যেগুলো থেকে আগত আলো এতই লাল সরন (redshift) হয়েছে যে তা দৃশ্যমান রেঞ্জে পড়ে না।
এই প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল—'টাইম মেশিন'-এর মতো অতীতের দিকে তাকানো। কারণ, মহাবিশ্বে আলো চলার সময় লাগে। ফলে যত দূরের কোনো বস্তু দেখা যায়, তত পুরনো সময়ের দৃশ্য ধরা পড়ে। ওয়েব এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং-এর মাত্র ২৮০ মিলিয়ন বছর পরের গ্যালাক্সিও শনাক্ত করেছেন—যা মহাবিশ্বের শৈশবকাল।
সৃষ্টির সন্ধানে: নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির জন্মদৃশ্য
ওয়েব দেখিয়েছে প্রোটোস্টার বা নবীন নক্ষত্রের জন্ম। প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রজন্মের আগে ও পরে ধুলোময় গ্যাসীয় মেঘের কাঠামো বিশ্লেষণ করতে পারছেন। এছাড়া 'স্টার ফর্মেশন' বা নক্ষত্র গঠনের গতি, উপাদান এবং গঠনতন্ত্রও এখন বিশদভাবে বোঝা যাচ্ছে।
একাধিক ছবি ও স্পেকট্রোস্কোপিক ডেটায় দেখা গেছে—বিশাল গ্যাসের মেঘে কিভাবে মাধ্যাকর্ষণের টানে ধ্বস নেমে নতুন নক্ষত্র তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিশ্লেষণ ভবিষ্যতের গ্রহগঠন ও সম্ভাব্য প্রাণের অস্তিত্ব বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বহির্জাগতিক গ্রহে প্রাণের ইঙ্গিত?
জেমস ওয়েব এমন এক যন্ত্র, যা এক্সোপ্ল্যানেট (পৃথিবীর বাইরের গ্রহ) এর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। বিভিন্ন গ্রহে পানির বাষ্প, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ সম্ভাব্য জৈব উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা এমন প্রযুক্তি পেলেন, যা বহির্জাগতিক গ্রহের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে—এমনকি প্রাথমিকভাবে বলা যায়, প্রাণের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে কি না, তা নির্ধারণের সূচনা হয়েছে।
নতুন রহস্য, নতুন প্রশ্ন
জেমস ওয়েব আমাদের সময়ের ঘনত্ব ও মহাবিশ্বের বিস্তৃতি নিয়ে এক নতুন ভাবনা দিচ্ছে। এটি শুধুমাত্র প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়—এটি মানুষের কৌতূহলের পরিপূর্ণ প্রকাশ। হাবল যেখানে থেমেছিল, ওয়েব সেখানে শুরু করেছে নতুন অনুসন্ধানের পথ।
একটি গ্যালাক্সির গঠন যেখানে কয়েকশ কোটি বছর লেগে যাওয়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে মাত্র কয়েকশ মিলিয়ন বছরেই সেই গঠনতন্ত্র তৈরি হয়েছে। এতে মহাবিশ্বের বিবর্তনের প্রচলিত তত্ত্বগুলো নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন—'কসমোলজির বই নতুন করে লিখতে হতে পারে'।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের জানাচ্ছে যে মহাবিশ্ব শুধু বিশাল নয়, বরং অনেক গভীর ও রহস্যময়। এর প্রতিটি চিত্র ও তথ্য ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণায় এক একটি ভিত্তিপ্রস্তর। আজ যা কল্পনা, কাল তা গবেষণার বিষয়—এটিই বিজ্ঞানের চলমান গতিপথ, এবং সেই যাত্রার অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে জেমস ওয়েব।