মহাকর্ষের সুর: ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষে কাঁপছে স্থান-কাল, শুনছে পৃথিবী

মহাকর্ষের সুর: ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষে কাঁপছে স্থান-কাল, শুনছে পৃথিবী
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মহাবিশ্ব এখন শুধু দেখা নয়, শোনাও যাচ্ছে—গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বলছে সেই অদৃশ্য গল্প, যা কোটি কোটি বছর আগেও ঘটে গেছে কিন্তু পৃথিবীতে ধরা পড়ছে আজ। আমরা অনেকদিন ধরে আকাশের তারার আলো দেখে মহাবিশ্বকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন—মহাবিশ্ব শুধু আলো নয়, কম্পনের মাধ্যমেও কথা বলে। এই কম্পনই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ, মহাবিশ্বের অদৃশ্য স্পন্দন, যা তৈরি হয় যখন দুটি ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন স্টার একে অপরের সঙ্গে বিপুল গতিতে ধাক্কা খায়।

এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ প্রথমবার শনাক্ত হয়েছিল ২০১৫ সালে, LIGO অবজারভেটরির মাধ্যমে। সেই ঐতিহাসিক আবিষ্কারটি কেবল একটি নতুন ধারা তৈরি করেনি—এটি মূলত মহাবিশ্ব বোঝার একটি একেবারে নতুন মাত্রা খুলে দেয়। এর সঙ্গে ইউরোপের Virgo ডিটেক্টর এবং জাপানের KAGRA যুক্ত হওয়ার পর, এই তরঙ্গ শনাক্তকরণ আরও বিস্তৃত ও নির্ভুল হয়েছে।


কীভাবে এই 'মহাজাগতিক স্পন্দন' ধরা পড়ে?

গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ আসলে স্থান-কাল বা স্পেসটাইম-এর গঠনে তৈরি হওয়া একপ্রকার কাঁপুনি। যখন দুটি উচ্চভরবিশিষ্ট জ্যোতিষ বস্তু—যেমন দুটি ব্ল্যাক হোল—কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে একে অপরের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একসময় একত্রে ধ্বংসাত্মকভাবে মিশে যায়, তখন সেই সংঘর্ষ এতটা শক্তিশালী হয় যে তার তরঙ্গ স্থানকালকে বেঁকিয়ে দেয়।

এই স্পন্দন পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে কয়েকশো কোটি বছরও সময় নিতে পারে, কিন্তু LIGO ও Virgo-এর মতো লেজার ইন্টারফেরোমিটারগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে তারা এক প্রোটনের চেয়েও ছোট দূরত্বের কম্পন শনাক্ত করতে পারে। এভাবেই আমরা জানি, মহাবিশ্বে কী ঘটেছিল—যেটা আমরা দেখতে পাইনি, কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি।


ব্ল্যাক হোলের নীরব সংঘর্ষ—কিন্তু বিজ্ঞানীরা শুনছেন

ব্ল্যাক হোল মূলত আলোরও অতীত—এর ভেতর থেকে আলোও বের হয় না। ফলে ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ দেখা তো দূরের কথা, তার অস্তিত্বও একসময় ছিল অনুমান নির্ভর। কিন্তু এখন, যখন দুটি ব্ল্যাক হোল একত্রে মিলিত হয়, তখন তার উৎপন্ন গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বিজ্ঞানীদের জানিয়ে দেয় ঠিক কোথায় এবং কখন সেই ঘটনা ঘটেছে।

এই তরঙ্গগুলো আমাদের এমনসব ঘটনার তথ্য দেয় যা আর কোনো মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়—কতটা ভর ছিল, সংঘর্ষের শক্তি কতটা ছিল, এমনকি এই মিলনের পরে ঠিক কী ধরনের ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়েছে।

নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ: স্বর্ণের জন্মগাথা

২০১৭ সালে, বিজ্ঞানীরা প্রথম শনাক্ত করেন দুটি নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। এই ঘটনা ছিল আরও বিস্ময়কর, কারণ একইসঙ্গে এর আলোও শনাক্ত করা গিয়েছিল। ফলে শুধু তরঙ্গ নয়, দৃশ্যমান প্রমাণও মিলেছিল। আর সেই আলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়—নিউট্রন স্টারের এই সংঘর্ষই মহাবিশ্বে স্বর্ণ, প্লাটিনাম এবং অন্যান্য ভারী মৌলের জন্মস্থল।


গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ মানে কী?

☞ এটি একটি কসমিক বার্তা—যা শুনতে না পারলে, জানাই যেত না কী ঘটেছে

☞ এটি আমাদের জানাচ্ছে কীভাবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে চরম ঘটনা ঘটে

☞ এটি এমন একটি টুল, যার মাধ্যমে দেখা যায় অদৃশ্য জগৎ



ভবিষ্যৎ দিগন্ত: মহাবিশ্বের গভীরতম স্পন্দন

আগামী দশকে, ভারত, জাপান ও ইউরোপের আরও উন্নত ডিটেক্টর যুক্ত হলে, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ পর্যবেক্ষণ আরও সূক্ষ্ম, নিয়মিত ও বিস্তৃত হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একদিন হয়তো বিগ ব্যাং-এর পরবর্তী স্পন্দন পর্যন্ত শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

মহাবিশ্বের ইতিহাস শুধু আলো নয়, কম্পনের মাধ্যমেও লেখা হয়েছে। আর এখন, আমরা সেই মহাজাগতিক কম্পন শুনে পড়তে শিখছি তার গভীর, গোপন অধ্যায়গুলো।

আমরা মহাবিশ্বকে শুধু "দেখি" না, এখন আমরা তাকে "শুনি"। আর সেটাই হচ্ছে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ—ভবিষ্যতের মহাকাশ বিজ্ঞানের শ্রুতিমধুর বিপ্লব।


সম্পর্কিত নিউজ