মস্তিষ্কের ভেলকি: যখন স্মৃতি বলে মিথ্যা গল্প

মস্তিষ্কের ভেলকি: যখন স্মৃতি বলে মিথ্যা গল্প
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

স্মৃতি—মানুষের পরিচয়, কিন্তু সবটা কি সত্যি? আমরা নিজেরা যা দেখেছি, শুনেছি, অনুভব করেছি—তাই তো আমাদের জীবনের সত্য। কিন্তু কী হবে যদি জানা যায়, আমাদের অনেক 'স্মৃতি' আদৌ সত্য নয়? শুনতে অবাক লাগলেও, বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় False Memory, অর্থাৎ মিথ্যা স্মৃতি—মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া এমন এক ধোঁয়াটে ছবি, যা বাস্তবে কখনো ঘটেইনি।

এই মানসিক প্রপঞ্চ শুধু কল্পনার ফল নয়, বরং নিউরোসায়েন্সের বাস্তব এক ঘটনা, যা প্রতিনিয়ত আমাদের সঙ্গে ঘটছে, অজান্তেই।
 

মিথ্যা স্মৃতি কীভাবে তৈরি হয়?

মানুষের স্মৃতি আসলে ক্যামেরার মতো নয় যে ঘটনার নিখুঁত ছবি ধরে রাখে। বরং, স্মৃতি প্রতিবার মনে করলেই নতুনভাবে 'গঠন' হয়। ঠিক যেমন ফটোশপে একটি ছবি সম্পাদনা করা যায়, তেমনভাবেই মস্তিষ্কও একটি স্মৃতি বারবার পরিবর্তন করে।

এখানেই শুরু হয় ভুলের খেলা।

যখন আপনি কোনও পুরনো ঘটনা কাউকে বারবার বলতে থাকেন, কিংবা অন্যের স্মৃতির সঙ্গে নিজেরটা মিলিয়ে নেন,

অথবা মানসিক চাপ, ট্রমা, বা ঘুমের ঘাটতির কারণে স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে যায়—

তখন মস্তিষ্ক "Fill in the gap" করতে গিয়ে বানিয়ে ফেলে এমন কিছু ঘটনা যা কখনো ঘটেনি।

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: মস্তিষ্কের কোন অংশ দায়ী?

মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস, অ্যামিগডালা, এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স—এই তিনটি প্রধান অঞ্চল মেমোরি প্রসেসিংয়ে যুক্ত। হিপোক্যাম্পাস তথ্য জমা রাখে, অ্যামিগডালা সেই তথ্যের সঙ্গে আবেগ যুক্ত করে, আর প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সিদ্ধান্ত নেয় কোন তথ্য প্রাসঙ্গিক।

এই সমন্বয়ে সামান্য কোনো গ্যাপ থাকলেই, মস্তিষ্ক "ঘটনা পূরণ" করতে গিয়ে ভুয়া স্মৃতি তৈরি করে ফেলে। বিশেষ করে আবেগপ্রবণ বা ট্রমাটিক ঘটনাগুলোতে False Memory হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

 

➤  বাস্তব জীবন ও False Memory

এটা ভাবা সহজ যে মিথ্যা স্মৃতি শুধু মানসিক রোগ বা বিকৃতির লক্ষণ। কিন্তু না—একটি সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কেও False Memory হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে:

একজন মানুষের স্মৃতির নির্ভুলতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষই মিথ্যা স্মৃতির শিকার হতে পারে।

এমনকি আদালতে সাক্ষী দেওয়া মানুষরাও নিজের মিথ্যা স্মৃতি 'সত্য' বলে বিশ্বাস করেন!

এই কারণেই বহু আইনি কেসে ভুল সাক্ষ্য মিথ্যা সিদ্ধান্তে নিয়ে গিয়েছে—যেখানে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃঢ় বিশ্বাস থাকলেও, ঘটনা আদৌ ঘটেনি।

 

মিথ্যা স্মৃতি থেকে বাঁচার উপায় কী?

আপনি নিজেও মিথ্যা স্মৃতির শিকার হতে পারেন—তবে কিছু কৌশলে তা এড়ানো সম্ভব:

⇨ তথ্য যাচাই করুন: মনে থাকা ঘটনার দলিল, তারিখ, ছবি বা অন্যের বয়ান মিলিয়ে নিন।

⇨ নিজের স্মৃতি নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হবেন না।

⇨  ঘুম, মনোযোগ এবং মানসিক প্রশান্তি স্মৃতি সঠিক রাখতে সাহায্য করে। 

⇨ "স্মৃতি" আর "তথ্য" এক নয়—এ কথা সব সময় মাথায় রাখুন।
 

আমরা অনেকেই ভাবি—"আমি যেটা মনে করি, সেটা নিশ্চয়ই ঘটেছে।" কিন্তু neuroscience বলছে, সেটা সব সময় সত্যি নয়। আপনার স্মৃতির ভেতরেই লুকিয়ে থাকতে পারে এমন কিছু ঘটনা, যা আপনি বিশ্বাস করেন, কিন্তু যা কখনোই ঘটেনি।

মস্তিষ্ক আমাদের চিন্তা, স্মৃতি, অনুভবের জগতকে প্রতিনিয়ত রচনা করে চলেছে। সেই নির্মাণ কখনো বাস্তব, আবার কখনো একেবারে কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা মিথ্যা ছবি। সতর্ক থাকুন—স্মৃতির এই ফাঁদে আপনি পড়ছেন কিনা!


সম্পর্কিত নিউজ