জিলহজ মাসের শুরুতেই কুরবানি প্রদানকারীদের জন্য বিশেষ বিধান

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ইসলাম ধর্মে জিলহজ মাস অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। বিশেষ করে এই মাসের প্রথম দশ দিন এবং কুরবানির দিন মুসলিমদের জন্য অশেষ ফজিলতের সময়। যারা কুরবানি করার নিয়ত করেন, তাদের জন্য রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শরঈ বিধান ও মানার মতো নিয়ম।
➤ চুল ও নখ কাটা: শরিয়তের কঠিন নিষেধাজ্ঞা
যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা রাখেন, জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে কুরবানির পশু জবাই না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য চুল, নখ এবং শরীরের বাড়তি পশম কাটা হারাম।
এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে,
"কেউ যদি জবাই করার জন্য কোন পশু প্রস্তুত রাখে এবং সে যিলহজ্জ মাসে প্রবেশ করে তখন সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে; যতক্ষণ না সে কোরবানি সম্পন্ন করে"। [সুনানে আবু দাউদ (২৭৯১) ,সহিহ মুসলিম (১৯৭৭) ]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে: "শরীরের চামড়া যেন না কাটে।" [সহীহ মুসলিম]
ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, এটি স্পষ্টভাবে হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এক্ষেত্রে সে নিজ হাতে জবাই করুক কিংবা অন্য কাউকে জবাই করার দায়িত্ব দিক উভয়টা সমান। আর পরিবারের অন্য সদস্যরা বা যাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা হবে, তাদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। যেহেতু এই মর্মে কোন দলিল নেই।
➤ জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনগুলোতে যেসব আমল করা মুস্তাহাব -
১. তাওবা করা (খাঁটি তাওবা/তাওবাতুন নাসূহা)
তাওবা অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ তা'আলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আল্লাহর নাফরমানি না করা ও তার হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। এ দিন গুলোতে তাওবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।
২. ফরজ ও নফল সালাত গুরুত্বসহ আদায়
ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরয সালাতগুলো সময় মত সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল সালাত আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: তুমি বেশি বেশি সেজদা কর, কারণ তুমি এমন যে কোনো সেজদাই কর না কেন তার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করবেন। [মুসলিম] এটা সব সময়রে জন্য প্রযোজ্য।
৩. আরাফার দিন রোজা রাখা:
জিলহজের প্রথম দশকের রোজা বিশেষ করে আরাফার দিন (৯ জিলহজ) রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: "আমি আশাবাদী আল্লাহ তা'আলা এই রোজার মাধ্যমে এক বছর আগের এবং এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।" [মুসলিম: ১১৬৩]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখবে, একদিনের রোজার বিনিময় তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর খারিফ দূরে রাখবে"। [বুখারী, ২৮৪০; মুসলিম: ১১৫৩।]
৪. হজ ও ওমরা করা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে।
তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:—'যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।' [বুখারি: ১৪৪৯, মুসলিম: ১৩৫০ ]
৫. আল্লাহর যিকির করা:
এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে যিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে:—
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এ দশ দিনে [নেক] আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল [লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ] তাকবীর [আল্লাহু আকবার] তাহমীদ [আল-হামদুলিল্লাহ] বেশি করে আদায় কর। [আহমদ, হাদিস: ১৩২]
৬. তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ:
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবীর পাঠ করবে। তাকবীর হল:— "আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।"
৮. কুরবানির দিন তথা দশ তারিখের আমল:
এ দিনের একটি নাম হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজীগণ তাদের পশু যবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিসে এসেছে:—
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোনো দিন? সাহাবিগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কুরবানির দিন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এটা হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। [আবু দাউদ: ১৯৪৫, আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।]
আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।[আবু দাউদ: ১৭৬৫ ]
৯. কুরবানি করা:
কুরবানি বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষে যবেহ করা।
ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কোরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্য দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন মজীদে যেমন এসেছে:—
'তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও (পশু) নাহর (কুরবানি) কর।'[সূরা কাউছার, আয়াত: ২]
'বল, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোনো শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।'[সূরা আন'আম, আয়াত: ১৬২, ১৬৩ ]
➤ অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানি দেওয়া: ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
কেউ চাইলে জীবিত অপর ব্যক্তির সম্মতিক্রমে তার পক্ষ থেকে কুরবানি করতে পারেন—সে ধনী হোক বা গরিব। এতে করে কুরবানিদাতা দানের সওয়াব পাবেন এবং যার পক্ষ থেকে কুরবানি করা হয়েছে, তিনিও কুরবানির সওয়াব লাভ করবেন।
তবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—কারও অনুমতি ছাড়া তার পক্ষ থেকে কুরবানি বৈধ নয়। ইমাম নওবি (রহ.) বলেন: "অন্যের অনুমতি ছাড়া তার পক্ষ থেকে কুরবানি করা যাবে না এবং কোনো মৃত ব্যক্তি যদি জীবিত অবস্থায় ওসিয়ত না করে যান, তাহলে তার পক্ষ থেকেও কুরবানি করা বৈধ নয়।" (আল-মিনহাজ)
➤ সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল
✔ কুরবানিদাতা জিলহজ মাসে চুল, নখ, চামড়া ইত্যাদি কাটবেন না
✔ ভুলবশত কাটলে কাফফারা নেই, তবে তাওবা করতে হবে
✔ স্ত্রী সহবাস, আতর লাগানো বা নতুন কাপড় পরা বৈধ
✔ কুরবানি অন্যের পক্ষ থেকে করা যাবে সম্মতির ভিত্তিতে
✔ মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করতে হলে অবশ্যই ওসিয়ত থাকতে হবে
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মর্যাদাপূর্ণ দিনগুলোতে আমলের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দিন। আমিন।