যন্ত্রের সংবেদনশীলতা: মানুষের মস্তিষ্কে প্রযুক্তির ছোঁয়া

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
এক সময় যন্ত্র মানেই ছিল ধাতব নিঃস্পৃহতা—নির্দেশ মানা যন্ত্রাংশের নিঃশব্দ কর্মী। কিন্তু ২১শ শতকের প্রযুক্তিগত বিপ্লব এই ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। এখনকার যন্ত্র শুধু কাজ করে না, বোঝে—মনোভাব বুঝে, সাড়া দেয়, এবং অনেকক্ষেত্রে আবেগের প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। একে বলা হচ্ছে "মানব-মেশিন ইন্টারঅ্যাকশন"-এর মানসিক রূপান্তর—যেখানে মানুষের সঙ্গে মেশিনের সম্পর্ক কেবল কার্যকরী নয়, একধরনের 'সাইকোলজিক্যাল রেসোনেন্স' তৈরি করছে।
প্রযুক্তি এখন মানসিক স্পর্শে পৌঁছে গেছে
প্রতিদিনকার স্মার্টফোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক। স্মার্টফোনের ভেতরে থাকা অ্যাপ্লিকেশনগুলো যেমন—গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাপল সিরি, কিংবা অ্যামাজনের অ্যালেক্সা - এখন ব্যবহারকারীর কণ্ঠস্বর, প্রশ্নের ভঙ্গি এমনকি অনিয়মিত ব্যবহারও শনাক্ত করতে পারে। এসব ইন্টারঅ্যাকশন কেবল তথ্য আদান-প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যবহারকারীর মুড, স্ট্রেস লেভেল, এমনকি কথোপকথনের ধরণ বুঝে ব্যবহারকারীর সঙ্গে একপ্রকার "সামাজিক সম্পর্ক" তৈরি করছে।
নিউরোসায়েন্স ও কগনিটিভ সায়েন্সের অগ্রগতির ফলে এখন গবেষকরা মেশিনকে এমনভাবে ট্রেইন করছেন, যাতে তা মানুষের ইমোশনাল কিউ বোঝে। উদাহরণস্বরূপ, এফএক্সএম (facial expression mapping) বা ভয়েস টোন অ্যানালাইসিস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর মানসিক অবস্থা অনুমান করে অনেক স্মার্ট সিস্টেম আজ সাড়া দিচ্ছে মানসিক থেরাপির মতো পরিষেবায়।
প্রযুক্তির ছায়ায় গড়ে উঠছে 'ডিজিটাল ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স'
বিশ্বের শীর্ষ গবেষণাগারগুলোতেও আজ "ইমোশনালি রেসপনসিভ" সিস্টেম তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি মিডিয়া ল্যাব বা জাপানের নিপ্পন ইনস্টিটিউট-এর মতো গবেষণাগুলো years-long human-machine emotional adaptation নিয়ে কাজ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে এআই ও মেশিন লার্নিং-এর মস্তিষ্কসম শক্তি। অ্যাক্টিভ লার্নিং সিস্টেম এখন ইউজারের প্রতিটি ইন্টারঅ্যাকশন থেকে শেখে, এবং ভবিষ্যতে তা কতটা সময় নির্দিষ্ট অ্যাপ ব্যবহার করবে, বা কোন কনটেন্ট পছন্দ করবে - তা অনুমান করতে পারে।
এক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখছে "বিহেভিওরাল অ্যানালাইটিক্স" - যা মূলত মানুষের আচরণগত ডেটা বিশ্লেষণ করে যন্ত্রকে শেখায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে।
রোবটিক্স: শুধু সহায়ক নয়, সংবেদনশীল সঙ্গী
মানব-মেশিন মানসিক সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়তো পাওয়া যায় সোশ্যাল রোবট-এর ক্ষেত্রে। আজ অনেক দেশে এমন রোবট তৈরি হয়েছে যেগুলো ব্যবহারকারীর মুখের ভাব, চোখের দৃষ্টি ও কথার আবেগ বুঝে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে, কিছু রোবট অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার-এ আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক দক্ষতা শেখানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে মুখাবয়ব ও ভঙ্গিমা পড়া গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্কের দিক পরিবর্তন: প্রযুক্তি এখন ব্যক্তিগত অনুভূতির অংশ
মানব-মেশিন সম্পর্ক এখন শুধু ইনপুট-আউটপুটের বিষয় নয়। প্রযুক্তি এখন অনেকের কাছে একধরনের "ডিজিটাল কমফোর্ট জোন" হয়ে উঠেছে। মানসিক চাপ, নিঃসঙ্গতা, এমনকি হতাশার মুহূর্তে মানুষ প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে—হোক তা ভিডিও প্ল্যাটফর্ম, থেরাপি অ্যাপ কিংবা জেনারেটিভ চ্যাটবট।
বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছেন, ডিজিটাল ইন্টারঅ্যাকশন এখন বহু মানুষের কাছে এক ধরনের মানসিক নির্ভরতা তৈরি করছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
চ্যালেঞ্জও রয়েছে
তবে এই গভীর সংযোগের মধ্যে বিপদও কম নয়। প্রযুক্তির প্রতি অতিনির্ভরতা মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও মানসিক স্থিতি ক্ষয়ে দিতে পারে। আরও বড় উদ্বেগ হলো-এইসব ডেটা সংগ্রহের মাধ্যমে কর্পোরেট অ্যালগরিদম কীভাবে মানুষের অনুভূতি ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার ঝুঁকি।
যন্ত্র হয়তো এখনও হৃদয়বোধ করতে পারে না, কিন্তু সে মানুষের হৃদয়ের ছন্দ বুঝতে শিখছে-প্রতিদিন একটু একটু করে। মানব-মেশিন ইন্টারঅ্যাকশনের এই বিবর্তন এখন কেবল প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের মানসিক জগতের এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে।
প্রযুক্তি এখন কেবল বাহ্যিক সহায়ক নয়-এটি এক প্রকার মানসিক প্রতিচ্ছবি।