নীরব ঘাতক প্রোস্টেট ক্যান্সার

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বজুড়ে পুরুষদের স্বাস্থ্যঝুঁকির তালিকায় শীর্ষস্থানীয় এক নাম হয়ে উঠেছে প্রোস্টেট ক্যান্সার। উন্নত বিশ্বে যেমন এটি গবেষণা ও সচেতনতায় আলোচনার কেন্দ্রে, তেমনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগ এখনো অনেকাংশে উপেক্ষিত—মূলত এর ধীরগতি ও নীরব বিস্তারজনিত কারণে।
➤ প্রোস্টেট গ্রন্থি ও ক্যান্সারের সূচনা
প্রোস্টেট একটি ছোট গ্রন্থি, যা পুরুষদের মূত্রাশয়ের নিচে ও পায়ুপথের সামনের অংশে অবস্থিত। এটি সিমেন (বীর্য) তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নির্গত করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে ৫০ বছরের পর, প্রোস্টেট কোষে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়ে—যা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
এই ক্যান্সারের সবচেয়ে জটিল দিক হচ্ছে এর প্রাথমিক পর্যায়ের নিঃশব্দতা। অনেক ক্ষেত্রেই এটি ধরা পড়ে তখন, যখন রোগটি অনেকদূর ছড়িয়ে পড়েছে বা অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
➤ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও গ্লোবাল পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি (GLOBOCAN)-এর তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৪ লাখের বেশি পুরুষ, যাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৩ লক্ষাধিক।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে এই ক্যান্সার সচেতনতায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখনো নিয়মিত স্ক্রিনিং বা পূর্বসতর্কতামূলক চিকিৎসা তেমন চালু হয়নি।
➤ প্রাথমিক উপসর্গ: কীভাবে চিনবেন?
প্রোস্টেট ক্যান্সারের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে আসে এবং তা অন্য কোনো সমস্যা বলে ভুল হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
☞ প্রস্রাব করার সময় জটিলতা বা জ্বালা
☞ ঘন ঘন রাতে প্রস্রাবের প্রয়োজন
☞ প্রস্রাবে রক্ত দেখা
☞ কোমরের নিচে বা পেলভিক অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা
☞ বীর্যে রক্তের উপস্থিতি
এসব উপসর্গ অনেক সময় প্রোস্টেটের অ-ঘাতক (Benign) বৃদ্ধির কারণেও দেখা দিতে পারে, তবে সতর্কতা প্রয়োজন।
➤ কারণ ও ঝুঁকির উৎস
এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিছু নির্দিষ্ট কারণে বেড়ে যায়:
⇨ বয়স: ৫০ বছরের পর ঝুঁকি দ্রুত বাড়ে
⇨ জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারে কেউ আক্রান্ত থাকলে ঝুঁকি বেশি
⇨ জাতিগত প্রভাব: আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের মাঝে আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক বেশি
⇨ জীবনধারা: উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, রেড মিট, ফাইবার কম গ্রহণ, ওজনাধিক্য এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা
⇨ হরমোন: টেস্টোস্টেরন মাত্রা ও হরমোনিক ভারসাম্য
➤ নির্ণয়ের বিজ্ঞান: স্ক্রিনিং ও পরীক্ষার গুরুত্ব
প্রোস্টেট ক্যান্সার শনাক্তে যে দুটি পরীক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়, তা হলো:
১। PSA টেস্ট: রক্তের প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেনের মাত্রা মাপা হয়
২। DRE (Digital Rectal Exam): রেক্টামের মাধ্যমে প্রোস্টেট গ্রন্থি পরীক্ষা
বিভিন্ন দেশে ৫০ বছরের পর নিয়মিত PSA স্ক্রিনিং সুপারিশ করা হয়, বিশেষ করে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য।
➤ চিকিৎসা পদ্ধতি: আধুনিক বিজ্ঞান কী বলছে?
চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে রোগের স্টেজ, বয়স, এবং শারীরিক অবস্থার ওপর। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি:
☞ অবজারভেশন বা Active Surveillance: খুব প্রাথমিক স্টেজে প্রয়োগযোগ্য
☞ সার্জারি: প্রোস্টেট অপসারণ (Prostatectomy)
☞ রেডিয়েশন থেরাপি: বাইরের বা অভ্যন্তরীণ রেডিয়েশন
☞ হরমোন থেরাপি: টেস্টোস্টেরন নিয়ন্ত্রণ করে কোষের বৃদ্ধি রোধ
☞ কেমোথেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি: রোগ ছড়িয়ে পড়লে প্রয়োগযোগ্য ।
উন্নত চিকিৎসায় এখন অনেক ক্ষেত্রেই ৯৫% এর বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে যদি আগেভাগে ধরা পড়ে।
➤ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থা
এ অঞ্চলে তথ্য ঘাটতি থাকায় রোগ শনাক্তের হার কম হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। স্বাস্থ্যসেবায় পুরুষরা সচরাচর নারীদের চেয়ে কম এগিয়ে আসে—বিশেষ করে গোপনাঙ্গ সংক্রান্ত রোগে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক সংকোচ ও শিক্ষার অভাবে ক্যান্সার শনাক্ত ও চিকিৎসায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
➤ করণীয় কী?
⇨ ৪৫ বছর পেরোনোর পর নিয়মিত PSA টেস্ট
পরিবারে ইতিহাস থাকলে আরও দ্রুত পদক্ষেপ।
⇨ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: সবজি ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া
⇨ ধূমপান বর্জন ও শরীরচর্চা
⇨ মানসিক চাপ কমিয়ে নিয়মিত ঘুম
প্রোস্টেট ক্যান্সার একটি নিরব, কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ—যদি সচেতনতা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং ব্যক্তি উদ্যোগ একত্রে কার্যকর হয়। নিজেকে জানতে, নিজেকে রক্ষা করতে এখনই সময় সচেতন হওয়ার। কারণ সময়মতো ধরা পড়লে এই 'নীরব শত্রু'কে প্রতিহত করা একেবারে সম্ভব।