মাটির নিচে শিকড়ের বিজ্ঞান ও গাছের পুষ্টি সংগ্রামের কাহিনি

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গাছকে যত্ন করে যারা দেখে, তাদের নজর যায় পাতার সবুজে বা কাণ্ডের দৃঢ়তায়। কিন্তু সেই দৃশ্যমান সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অবিরাম সংগ্রাম—মাটির নিচে শিকড়ের বিস্তৃতি, পরিশ্রম আর প্রজ্ঞা। চোখের আড়ালে থাকা এই শিকড়ই গাছের জীবনের মূল ভিত্তি। এই শিকড়ই গাছকে দেয় জীবনীশক্তি, পানি ও পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে, মাটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং জীবনের গভীরে প্রোথিত থাকে।
আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞান বলছে, শিকড়ের গঠন ও কাজ অনেকটাই একটি বুদ্ধিমান নেটওয়ার্কের মতো, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও খাদ্য শৃঙ্খল বজায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিকড়ের কাঠামো: চোখের আড়ালে এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া
গাছের শিকড় প্রধানত তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত—
১। মাথার দিকের 'ক্যাপ' অঞ্চল,
২। বৃদ্ধির অঞ্চল এবং
৩। শোষণ এলাকা।
শিকড়ের অগ্রভাগে থাকে শিকড় টুপি (root cap), যা মাটি খনন করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। বৃদ্ধির অঞ্চলে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে শিকড় প্রসারিত হয় এবং শোষণ এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিকড়রোম (root hairs) থাকে, যা মাটি থেকে পানি ও খনিজ উপাদান শোষণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
পুষ্টি শোষণ: প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার নিখুঁত সমন্বয় -
মাটি থেকে পানি ও খনিজ উপাদান গ্রহণে শিকড় ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া। মূলত 'অস্মোসিস' এবং 'সক্রিয় পরিবহন' (active transport) প্রক্রিয়ায় পানি ও খনিজ শোষিত হয়। শিকড়রোমের বিশাল পরিমাণ পৃষ্ঠদেশ এই শোষণ ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। শিকড়ে থাকা এক্সাইলেম টিস্যুর মাধ্যমে পানি ও খনিজ উঠে যায় কাণ্ডে এবং পরিশেষে পৌঁছে যায় পাতায়, যেখানে ঘটে ফটোসিনথেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ।
শিকড়ের সিদ্ধান্ত: প্রকৃতির বুদ্ধিদীপ্ত সেন্সর -
গবেষণায় দেখা গেছে, শিকড় শুধু শোষণেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি মাটির অবস্থা বোঝে, উপাদানের ঘাটতি বা অতিরিক্ততা শনাক্ত করে এবং সেই অনুযায়ী নিজের বৃদ্ধি বা দিক পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে বেশি নাইট্রোজেন থাকে, শিকড় সেই দিকে প্রসারিত হয়। আবার কিছু শিকড় ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সঙ্গে মাইকোরাইজাল সম্পর্ক স্থাপন করে, যা মাটির গভীর থেকে ফসফরাসের মতো কঠিন উপাদান সংগ্রহে সহায়তা করে।
পরিবেশ রক্ষা ও কৃষিতে শিকড়ের গুরুত্ব-
শুধু গাছের নয়, সমগ্র পরিবেশের জন্য শিকড় একটি অপরিহার্য অংশ। এটি মাটির ক্ষয় রোধ করে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে এবং কার্বন সংরক্ষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়তা করে। আধুনিক কৃষিতেও শিকড়ের গঠন ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ফসলের জন্য উপযোগী চাষের কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, একটি শিকড় শুধুমাত্র গাছের নিচের অংশ নয়, এটি এক প্রাকৃতিক গবেষণাগার, সেন্সর এবং জীবনরক্ষাকারী জৈব প্রযুক্তি। এই শিকড়ের জটিল গঠন ও শোষণ পদ্ধতি বোঝা মানেই গাছের জীবনচক্র এবং আমাদের পরিবেশকে আরও ভালোভাবে বোঝা। প্রকৃতির এই নিখুঁত প্রযুক্তিকে সম্মান করা এবং সংরক্ষণ করাই এখন সময়ের দাবি।