স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বদলে দিচ্ছে পৃথিবীর যোগাযোগ মানচিত্র

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
যেখানে সড়ক নেই, নেই বৈদ্যুতিক খুঁটি, এমনকি মোবাইল টাওয়ারও অনুপস্থিত—সেই দুর্গম পাহাড়, মরুভূমি কিংবা সমুদ্রের মাঝেও এখন পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেট। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছে মহাকাশে ঘুরতে থাকা হাজারো ক্ষুদে স্যাটেলাইট।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি দিগন্তের নাম এখন স্যাটেলাইট ইন্টারনেট। এটি শুধু ডিজিটাল সংযোগের একটি নতুন মাধ্যম নয়, বরং আগামী দিনের বৈশ্বিক যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য একটি কৌশলগত হাতিয়ার।
মহাকাশ থেকে ইন্টারনেট: কীভাবে সম্ভব?
এই প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হলো Low Earth Orbit (LEO) স্যাটেলাইট, যেগুলো পৃথিবী থেকে মাত্র ৫০০–২,০০০ কিলোমিটার উপর দিয়ে ঘুরে থাকে।
প্রথাগত ফাইবার অপটিকের মতো স্থলভিত্তিক কাঠামোর পরিবর্তে, LEO স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি গ্রাহকের ছাদে থাকা একটি ছোট্ট ডিশে সংযোগ পৌঁছে যায়। যার ফলে বিদ্যমান কাঠামোর ওপর নির্ভর না করেই ইন্টারনেট পৌঁছে যায় যেকোনো অঞ্চলে।
স্টারলিঙ্ক: মহাকাশ-নেটওয়ার্কের রাজপথ
স্টারলিঙ্ক, এলন মাস্কের SpaceX পরিচালিত প্রকল্পটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক।
২০২৫ সাল পর্যন্ত তারা ইতিমধ্যে উৎক্ষেপণ করেছে ৬,৫০০-এরও বেশি স্যাটেলাইট।
লক্ষ্যমাত্রা: প্রায় ১২,০০০ স্যাটেলাইট দিয়ে একটি বৈশ্বিক ইন্টারনেট গ্রিড তৈরি।
বর্তমানে ৭৫+ দেশে সার্ভিস চালু, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, দুর্গম দ্বীপপুঞ্জ এবং আর্কটিক অঞ্চল।
স্টারলিঙ্কের স্পিড ও ল্যাটেন্সি (পিঙ্গ টাইম) এখন অনেক সময়েই ফাইবার অপটিকের সমতুল্য—যা একসময় কল্পনার ব্যাপার ছিল।
ওয়ানওয়েব: ভারসাম্য ও সহাবস্থানের পথে
স্টারলিঙ্কের পাশাপাশি ব্রিটেনভিত্তিক ওয়ানওয়েব এখন একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাদের লক্ষ্য কেবল বাণিজ্যিক সংযোগ নয়, বরং সরকারী, মানবিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন কমানো।
ওয়ানওয়েব ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০টি স্যাটেলাইট নিয়ে তাদের কনস্টেলেশন গঠন করেছে। ভারত, কানাডা, আলাস্কা, আফ্রিকা—প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর জন্য স্থানীয় টেলিকম অপারেটরদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের বাস্তব প্রভাব
⇨ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: যেসব অঞ্চল যুগের পর যুগ প্রযুক্তির বাইরে ছিল, সেগুলো এখন সংযুক্ত হচ্ছে শিক্ষার, ব্যবসার ও চিকিৎসার মূল স্রোতে।
⇨ দুর্যোগে জরুরি সেবা: ভূমিকম্প, সুনামি বা যুদ্ধের মতো সময়েও স্যাটেলাইট সংযোগ অটুট থাকে, যা তাৎক্ষণিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ।
⇨ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যবসা ও সামরিক যোগাযোগ: একাধিক স্যাটেলাইট সরাসরি স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী এমনকি বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের ছক
যদিও সম্ভাবনা বিশাল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে:
◑ ব্যয়: সেবার মূল্য এবং স্টার্টার কিট এখনও অনেকের জন্য ব্যয়বহুল।
◑ স্পেস ডেব্রিস: কক্ষপথে ক্রমবর্ধমান স্যাটেলাইটের ভিড় মহাকাশে সংঘর্ষ এবং অন্যান্য মিশনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
◑ আইনি ও সাইবার নিরাপত্তা: স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ককে ঘিরে রয়েছে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ, হ্যাকিং ঝুঁকি এবং জাতীয় নিরাপত্তার নানা প্রশ্ন।
আগামী দিনের যোগাযোগ: আকাশ হবে প্রধান সড়ক
বিশ্ব টেলিকম গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করবে শুধুমাত্র স্যাটেলাইট ভিত্তিক সংযোগের মাধ্যমে।
এছাড়াও আসছে AI-চালিত কানেক্টিভিটি, স্যাটেলাইট ৫জি, এবং মোবাইল চলন্ত যানবাহনে সরাসরি সংযোগের নতুন যুগ।
মহাকাশের কোনো কল্পনার গল্প নয়—স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এখন পৃথিবীর বাস্তবতা। এটি শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, বরং মানবিক উন্নয়নের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠছে।
শুধু শহর নয়, এখন গ্রামের ছেলেমেয়েও মহাকাশের ছোঁয়ায় ডিজিটাল দুনিয়ার সদস্য হতে পারছে। আর এর মাধ্যমেই গড়ে উঠছে এক নতুন বৈশ্বিক ভারসাম্য, যেখানে সংযোগ মানেই সমতা।