"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" - করুণা ও কল্যাণের চাবিকাঠি

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
পবিত্র কুরআনের সূচনা বাক্য "بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ"— অর্থাৎ "শুরু করছি আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতিশয় দয়ালু"— শুধু একটি বাক্য নয়, এটি মুসলমানের জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার মূলমন্ত্র। এটি ইসলামী সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ১১৩টিতে এই আয়াত রয়েছে। আজকের এই ব্যস্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত পৃথিবীতে মুসলিম সমাজে 'বিসমিল্লাহ্' বলার গুরুত্ব ও বাস্তব প্রভাব নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে।
➤ বিসমিল্লাহর অর্থ ও গুরুত্ব -
"বিসমিল্লাহ" আরবিতে তিনটি শব্দ নিয়ে গঠিত—
بِ (বি): 'সাথে', 'সাহায্যে'
اسْمِ (ইসম): নাম
اللَّهِ (আল্লাহ): সৃষ্টিকর্তার পবিত্র নাম
الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ: দুটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যার অর্থ "পরম করুণাময়" ও "অতিশয় দয়ালু"
ইসলামী তাফসিরবিদরা বলেন, এই বাক্যটি মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয়—প্রত্যেক ভালো কাজ আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা উচিত, যাতে তাতে বরকত ও সাফল্য আসে।
➤ ওহির সূচনা: "ইকরা বিসমে" – বিসমিল্লাহর পবিত্র আবির্ভাব -
ইসলামের প্রারম্ভিক ইতিহাসে বিসমিল্লাহ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি প্রথম ওহি নাজিল হয় হিরা গুহায়, যেখানে সূরা আল-আলাক-এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাজিল হয়েছিল:
"اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ"
("পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন") — সূরা আল-আলাক: ১
এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহর নাম নিয়ে জ্ঞানার্জন, পাঠ, এবং যেকোনো মহৎ কাজ শুরু করা ইসলামে কতটা গুরুত্ব বহন করে। ফলে অনেক তাফসিরবিদ মনে করেন, কুরআনের প্রতিটি সূরার শুরুতে "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" স্থাপনও এক ঐশী রীতি ও নির্দেশনার অংশ।
ইমাম আবু দাউদের একটি সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে:
"রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরার শেষ বুঝতে পারতেন, যখন বিসমিল্লাহ নাযিল হতো।" — [আবু দাউদ: ৭৮৮]
এটি ইঙ্গিত দেয় যে, কুরআনের সূরাগুলোর পার্থক্য ও প্রারম্ভ ঘোষণার মাধ্যম হিসেবেও বিসমিল্লাহ কাজ করে।
➤ বিসমিল্লাহর তাৎপর্য এবং ইসলামী জীবনে বহুমাত্রিক ব্যবহার-
বিসমিল্লাহ বলা শুধু একটি বাক্য পাঠ নয়, এটি মূলত একটি প্রার্থনা, একটি স্বীকৃতি, এবং একটি দাওয়াত আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য। এর মাধ্যমে মুসলিম স্বীকার করে—জীবনের সকল নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, এবং দ্বীন ও শরিয়ত আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের ফসল।
এটি কেবল কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতেই নয়, বরং প্রতিটি জায়েয (শরিয়তসিদ্ধ) কাজের শুরুতেও পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যেমন,
☞ তিনি প্রতিদিন সকাল বিকাল বলতেন,
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
"আমি সে আল্লাহর নামে শুরু করছি যার নামে শুরু করলে যমীন ও আসমানে কেউ কোন ক্ষতি করতে পারে না, আর আল্লাহ তো সব কিছু শুনেন ও সবকিছু দেখেন।" [আবু দাউদ: ৫০৮৮, ইবনে মাজাহ: ৩৮৬৯]
☞ অনুরূপভাবে যখন তিনি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি লিখেন তাতে বিসমিল্লাহ লিখেছিলেন [বুখারী, ৭]
☞ তাছাড়া তিনি যে কোন ভাল কাজে বিসমিল্লাহ বলার জন্য নির্দেশ দিতেন। যেমন, খাবার খেতে, [বুখারী ৫৩৭৬, মুসলিম: ২০১৭, ২০২২]
☞ দরজা বন্ধ করতে, আলো নিভাতে, পাত্র ঢাকতে, পান-পাত্র বন্ধ করতে [বুখারী ৩২৮০]
☞ কাপড় খুলতে [ইবনে মাজাহ ২৯৭, তিরমিযী: ৬০৬)
☞ স্ত্রী সহবাসের পূর্বে [বুখারী: ৬৩৮৮, মুসলিম: ১৪৩৪],
☞ ঘুমানোর সময় [আবু দাউদ: ৫০৫৪],
☞ ঘর থেকে বের হতে [আবু দাউদ: ৫০৯৫],
☞ চুক্তিপত্র/ বেচা-কেনা লিখার সময় [সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ৫/৩২৮],
☞ চলার সময় হোঁচট খেলে [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৫৯],
☞ বাহনে উঠতে [আবু দাউদ: ২৬০২]
☞ মসজিদে ঢুকতে [ইবনে মাজাহ: ৭৭১, মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৮৩],
☞ বাথরুমে প্রবেশ করতে [ইবনে আবি শাইবাহ: ১/১১],
☞ হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতে [সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ৫/৭৯]
☞ যুদ্ধ শুরু করার সময় [তিরমিযী: ১৭১৫]
☞ শক্র দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ব্যাথা পেলে বা কেটে গেলে [নাসায়ী: ৩১৪৯]
☞ ব্যাথার স্থানে ঝাড়-ফুঁক দিতে [মুসলিম: ২২০২]
মৃতকে কবরে দিতে তিরমিযী: ১০৪৬]।
☞ আবার কোথাও কোথাও 'বিসমিল্লাহ' বলা ওয়াজিবও বটে যেমন, যবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বললে, শরীয়ত মতে সেই যবাই বৈধ হয় না, যা প্রমাণিত হয়েছে বুখারী ও মুসলিমের সহীহ হাদীসে [বুখারী: ৯৮৫, মুসলিম: ১৯৬০]।
➤ বিসমিল্লাহ: আত্মসমর্পণের ঘোষণা
মানুষের সীমিত ক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে, আল্লাহর নামে কাজ শুরু করা মানে হচ্ছে—আত্মভরসার পরিবর্তে আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা স্থাপন করা। এক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তি যেন এই দোয়া করে—
"হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার কালাম বুঝবার এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন।"
➤ গুরুত্ব-
আয়িশা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, "যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি খাদ্য খাবে সে যেন বিসমিল্লাহ বলে। যদি বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায় তাহলে সে যেন বলে, বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু"। (আবু দাউদ হা-৩৭৬৭, ইবনু মাজাহ হা-৩২৬৪)।
ইসলামে বিসমিল্লাহর গুরুত্ব ও বরকত অপরিসীম। বিসমিল্লাহ না বলার কারণে একটি হালাল খাদ্য হারাম হয়ে যেতে পারে, আবার বিসমিল্লাহ না বলার কারণে নিয়ত শুভ থাকলেও অনেক কর্মে বরকত না হওয়ায় অনেকসময় ব্যাক্তির অসন্মানিত হতে হয়। কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা হলে সে কাজে আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতারিত হতে থাকে। শয়তান সেখানে অবস্থান নিতে পারে না। মুহাম্মদের (সা.) কাছে প্রথম ওহী অবতরণের সময়ও এই বাক্য পড়ানো হয়েছিল।
➤ বাস্তব জীবনে বিসমিল্লাহ্র প্রভাব
আধুনিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, মানুষ যখন কোনো কাজ আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতার সাথে শুরু করে, তখন তার সাফল্যের হার অনেক বেশি হয়। মুসলমানদের জন্য এই মনোসংযোগ ও আত্মবিশ্বাসের সূচনা হয় "বিসমিল্লাহ" বলে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন মুসলমান ব্যবসায়ী যখন তার দোকান খুলে 'বিসমিল্লাহ' বলেন, তখন তিনি একদিকে বরকতের আশা করেন, অন্যদিকে আত্মবিশ্বাসী হন যে, তার রিযিক হালাল ও নিরাপদ হবে। এমন অনেক শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-ছাত্রী আছেন যারা পরীক্ষা, কাজ, ভ্রমণ কিংবা যেকোনো নতুন কাজ শুরুর আগে বিসমিল্লাহ বলেন এবং আত্মতৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন।
➤ সংসার ও পারিবারিক জীবনে বিসমিল্লাহ্
রাসূল (সা.) বলেছেন:
"তোমাদের কেউ যখন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে চায়, তখন বলুক— 'বিসমিল্লাহ্, আল্লাহুম্মা জন্নিবনাশ শাইতান, ওয়া জন্নিবিশ শাইতানা মা রাযাক্তানা।'
(অর্থঃ হে আল্লাহ! আমাদের শয়তান থেকে রক্ষা করো এবং তুমি আমাদের যা দান করো, তাকে শয়তান থেকে রক্ষা করো)।" — (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৪১)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, বিসমিল্লাহ শুধুই একটি বাক্য নয়; এটি পরিবার গঠনে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করার প্রার্থনা।
"বিসমিল্লাহ" বলা মুসলিম জীবনের এক অলঙ্ঘনীয় আদর্শ। এটি কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং এক অন্তরগত প্রশান্তি, সুরক্ষা এবং সফলতার সূত্র। বর্তমান দুঃসময়ে যখন মানসিক চাপ, অস্থিরতা ও বিপদাপদ আমাদের চারপাশে, তখন 'বিসমিল্লাহ' আমাদের আস্থা, দিকনির্দেশনা এবং সুরক্ষার পথ দেখায়।
আসুন, আমরা জীবনের প্রতিটি কাজ "বিসমিল্লাহ" বলে শুরু করি। এতে আল্লাহর রহমতও মিলবে, শান্তিও আসবে, ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র:
সহীহ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ
তাফসির ইবনু কাসীর, আল-তাবারী
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ