কগনিটিভ ডিসোন্যান্স আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করে!!

কগনিটিভ ডিসোন্যান্স আমাদের  কিভাবে প্রভাবিত করে!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আপনি কি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন যেখানে নিজের একটি বিশ্বাসের সাথে আপনার আচরণ মেলে না, আর তারপর মনটা অস্বস্তিতে ভরে যায়? এমন অনুভবের পিছনে যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে, তার নাম কগনিটিভ ডিসোন্যান্স বা জ্ঞানগত দ্বন্দ্ব।

কী এই কগনিটিভ ডিসোন্যান্স?

এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি তার নিজের বিশ্বাস, মানসিকতা বা অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা আচরণ করে বসেন, ফলে মানসিক অস্বস্তি তৈরি হয়।উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি ধূমপান করেন কিন্তু বিশ্বাস করেন যে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তখন তার মনে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ সংঘাত। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য মানুষ নানা রকম যুক্তি দাঁড় করায়—যেমন "অনেকেই তো ধূমপান করেও দীর্ঘজীবী হয়েছেন।"
 

বিজ্ঞানের চোখে কগনিটিভ ডিসোন্যান্স-

প্রথমবার 'কগনিটিভ ডিসোন্যান্স' শব্দটি জনপ্রিয়তা পায় ১৯৫৭ সালে সামাজিক মনোবিজ্ঞানী লিওন ফেস্টিংগারের গবেষণার মাধ্যমে। তিনি দেখান যে মানুষ একাধিক বৈপরীত্যপূর্ণ বিশ্বাস বা তথ্যের মাঝে পড়লে এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করে। এই চাপ থেকে মুক্তির জন্য তারা হয় বিশ্বাস পাল্টায়, নয়তো নিজেদের আচরণকে যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে।

আধুনিক নিউরোসায়েন্স এই ধারণাকে আরও শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিসোন্যান্সের সময় মস্তিষ্কের anterior cingulate cortex ও prefrontal cortex অংশগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে—যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজ হয়।
 

মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে এই দ্বন্দ্বে প্রতিক্রিয়া জানায়?

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান জানাচ্ছে, যখন কগনিটিভ ডিসোন্যান্স তৈরি হয়, তখন মস্তিষ্কের দুইটি বিশেষ অংশ - anterior cingulate cortex ও dorsolateral prefrontal cortex - সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলগুলো সমস্যা শনাক্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করে।

আচরণগত গবেষণায় দেখা গেছে, এই অবস্থায় মানুষ "জাস্টিফিকেশন মেকানিজম" চালু করে—অর্থাৎ নিজের অসংলগ্ন আচরণকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে মানসিক অস্বস্তি কমাতে চায়।

যেমন, একজন স্মোকার যিনি জানেন ধূমপান ক্ষতিকর, তিনি হয় বলেন "আমি শুধু স্ট্রেস কমাতে করি," অথবা "নানা, আসলে এসব অতিরঞ্জিত তথ্য!"
 

বাস্তব জীবনে এর প্রবল প্রভাব

১. ব্যক্তিগত জীবন:

নিজেকে 'সৎ' ভাবেন, অথচ ছোট ছোট মিথ্যে বলেন? কিংবা স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে চিন্তা করেন, তবুও ফাস্ট ফুড ছাড়তে পারছেন না? এই অসংগতি আমাদের আত্মমর্যাদা ক্ষয়ে দেয়, অথচ আমরা সেটা ঢাকতে 'কগনিটিভ টুলস' ব্যবহার করি।

২. রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শে:

কগনিটিভ ডিসোন্যান্স সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসে। কেউ যখন নিজের সমর্থিত নেতার অনৈতিক আচরণ দেখেও সমর্থন জারি রাখেন, তখন তিনি নিজের মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য তথ্যকে বিকৃতভাবে গ্রহণ করেন—যা "confirmation bias" নামে পরিচিত।

৩. ভোক্তা আচরণে:

যখন আপনি দামি ফোন কেনার পর মনে করেন, "এই ফোনই সেরা"— তখন সেটি অনেকাংশেই আপনার টাকা খরচের পর তৈরি হওয়া ডিসোন্যান্স মেটানোর কৌশল।
 

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরণের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘ সময় ধরে চললে ব্যক্তি মানসিক ক্লান্তি, সিদ্ধান্তহীনতা এমনকি আত্ম-অবিশ্বাসে ভুগতে পারেন। কগনিটিভ ডিসোন্যান্সের পুনরাবৃত্তি হলে মানুষ বাস্তবতার বিকৃতি ঘটায়, নিজেকে না জেনেই ভুল পথকে সত্য বলে ধরে নেয়।


নিজেকে বোঝা ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিক

এই মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটি মানসিক স্বাস্থ্য বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। নিজের ভিতরের সংঘাতকে চিহ্নিত করা এবং তা স্বীকার করা মানসিক স্বচ্ছতা ও আত্ম-উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ।

মনোবিজ্ঞানীরা পরামর্শ দেন—নিয়মিত আত্মপর্যালোচনা ও স্বীকারোক্তির মাধ্যমে কগনিটিভ ডিসোন্যান্সকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায়। দ্বন্দ্ব এড়ানোর বদলে সেটিকে উপলব্ধি করে মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

 

কিভাবে মুক্তি মিলতে পারে?

স্বীকৃতি দিন: প্রথম ধাপ হলো দ্বন্দ্বকে মেনে নেওয়া।

নিজের বিশ্বাস ও আচরণ পর্যালোচনা করুন।

ডেটা ও বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিন, অনুভূতিকে নয়।

দীর্ঘ মেয়াদি মানসিক প্রশিক্ষণ বা CBT (Cognitive Behavioral Therapy) এই দ্বন্দ্ব 

সামলাতে কার্যকর হতে পারে।
 

কগনিটিভ ডিসোন্যান্স আমাদের চিন্তা ও আচরণের অদৃশ্য নাট্যনির্দেশক। এটি বোঝা মানে নিজের আচরণের অর্ন্তদৃষ্টি পাওয়া। মানুষ হিসেবে আমরা পরিপূর্ণ নই, কিন্তু আত্মবিরোধ চিনে তার পেছনের বিজ্ঞান বোঝা আমাদের একটি সাহসী ও সচেতন সমাজের পথে এগিয়ে নিতে পারে।

"নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে অস্বীকার নয়, বরং বুঝে নিলেই শুরু হয় আত্মউন্নয়নের পথচলা।"


সম্পর্কিত নিউজ