মস্তিষ্কের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার - এর বৈজ্ঞানিক রহস্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একটি শব্দ—হয়তো গাড়ির ব্রেকের চিৎকার, কিংবা আচমকা বাজ পড়া—অনেকের কাছে এটি সাধারণ শব্দমাত্র। কিন্তু কারও জন্য এটি হতে পারে একটি ভয়ংকর ঘটনার রিমাইন্ডার, যা মুহূর্তেই শরীরের হরমোন ব্যালেন্স এলোমেলো করে দিতে পারে, দেহে ঘাম এনে দিতে পারে, হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে পারে, এমনকি মুহূর্তেই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতায়। এরই নাম পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা সংক্ষেপে PTSD।
যুদ্ধক্ষেত্র, যৌন সহিংসতা, সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা শিশু বয়সে অভিভাবকের সহিংসতা—এমন যেকোনো অভিজ্ঞতা, যেটি একজন মানুষকে মানসিকভাবে নাড়িয়ে দেয়, তারই দীর্ঘস্থায়ী ফল হতে পারে PTSD।
PTSD মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ করে?
PTSD হলো স্নায়ুবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, ও হরমোনগত ভারসাম্যহীনতার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া। ট্রমাটিক ঘটনা মস্তিষ্কের তিনটি প্রধান অংশে সরাসরি প্রভাব ফেলে:
⇨ অ্যামিগডালা (Amygdala) – ভয় ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। PTSD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্তভাবে উত্তেজিত থাকে, ফলে ক্ষুদ্র উদ্দীপনাতেও ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
⇨হিপোক্যাম্পাস (Hippocampus) – স্মৃতি সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যায় ভূমিকা রাখে। PTSD-তে হিপোক্যাম্পাস সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, ফলে মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে "পুরনো ঘটনা" ও "বর্তমান সময়" আলাদা করতে ব্যর্থ হয়।
⇨ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex) – সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। PTSD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এর কার্যক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে আবেগগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
বিজ্ঞান যা বলছে -
একাধিক নিউরোইমেজিং স্টাডি থেকে জানা গেছে, PTSD আক্রান্তদের মস্তিষ্কে কর্টিসল নামক স্ট্রেস-হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিক রকমের কম থাকে। অন্যদিকে, অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহ থাকে বেশি, যা শরীরকে "ফাইট-অর-ফ্লাইট" মোডে রাখতে বাধ্য করে।
দীর্ঘমেয়াদী PTSD থাকলে এটি ব্রেইন প্লাস্টিসিটি কমিয়ে দেয়, যার ফলে নতুন অভিজ্ঞতা শেখার ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
উপসর্গগুলোর ছদ্মবেশ:
PTSD-এর লক্ষণগুলো অনেক সময় সাধারণ উদ্বেগ বা ডিপ্রেশনের মতোই মনে হতে পারে:
⇨ হঠাৎ আতঙ্কের ঢেউ আসা
⇨ নিদ্রাহীনতা বা দুঃস্বপ্ন
⇨ অতীত ঘটনার রিগ্রেশন বা 'ফ্ল্যাশব্যাক'
⇨সম্পর্ক বা সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা
⇨ অতিরিক্ত সতর্কতা বা আগ্রাসী আচরণ
এই উপসর্গগুলো কেউ একজন যতই গোপন করার চেষ্টা করুন না কেন, এগুলো ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
কে বেশি ঝুঁকিতে?
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা PTSD-তে পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত হন।
শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে, পারিবারিক সহিংসতা বা বারবারের নির্যাতন এই ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
যুদ্ধফেরত সেনা সদস্য, দুর্ঘটনা বেঁচে-ফেরা মানুষ, ধর্ষণের শিকার নারীরা PTSD-এর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
চিকিৎসা ও পুনর্বাসন: এক লম্বা পথচলা
PTSD চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে:
⇨ কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি (CBT) – যেখানে ট্রমাটিক চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করে ধীরে ধীরে সেগুলোর অর্থ পুনঃনির্মাণ করা হয়।
⇨ Eye Movement Desensitization and Reprocessing (EMDR) – যেখানে চোখের গতি ও নির্দিষ্ট শব্দ ব্যবহার করে ট্রমা সংযুক্ত স্মৃতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়।
⇨কিছু ক্ষেত্রে ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যেমন SSRIs গ্রুপের অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট।
⇨ পাশাপাশি, মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং সামাজিক সংযোগ
- সব মিলিয়ে এই যুদ্ধে একজন মানুষকে জয়ী হতে সাহায্য করে।
সমাজের দায়িত্ব কী?
PTSD কোনো "ভেতরের দুর্বলতা" নয় — এটি একটি স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ও মানসিক আঘাতের ফলাফল। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে এখনো অনেক ভুল ধারণা ও কলঙ্ক জড়িয়ে আছে। এই মানসিক প্রতিবন্ধকতা ভাঙার জন্য প্রয়োজন:
⇨ সচেতনতা
⇨ সহানুভূতিশীল শ্রবণ
⇨ সময়োপযোগী চিকিৎসা-সহায়তা
PTSD এমন এক 'অদৃশ্য ক্ষত', যা শরীরে নয়, বরং মস্তিষ্কের গভীরে সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটির প্রতিটি কম্পন বাস্তব, প্রতিটি যন্ত্রণা প্রমাণযোগ্য, এবং প্রতিটি নিরাময় সম্ভব — যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ এটিকে একটি বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করে।
ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হলে, অতীতের যন্ত্রণা শুধু ভুলে নয় — বুঝে, স্বীকার করে, এবং মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে তবেই এগোতে হবে।