পুরুষের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ইরেকটাইল ডিসফাংশন

পুরুষের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ইরেকটাইল ডিসফাংশন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একটি সময় ছিল, যখন 'ইরেকটাইল ডিসফাংশন' (Erectile Dysfunction - ED) বিষয়টি কেবল বয়স্ক পুরুষদের সমস্যা বলে ধরা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা এবং চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ বলছে ভিন্ন কথা।

বয়স ৩০ পেরোতেই বহু পুরুষ যৌন অক্ষমতার অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন, এবং এ সংখ্যা দিনে দিনে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। অথচ অধিকাংশই এ বিষয়ে চুপ থাকেন—লজ্জা, সামাজিক কুসংস্কার এবং ভুল ধারণার কারণে।
 

ইরেকটাইল ডিসফাংশন আসলে কী?

পুরুষের যৌন উত্তেজনার সময় পুরুষাঙ্গ দৃঢ় না হওয়া বা তা ধরে রাখতে না পারাকে ইরেকটাইল ডিসফাংশন বলা হয়। এটি কোনো তাৎক্ষণিক বা সাময়িক সমস্যা নয়—বরং যদি এটি বারবার ঘটে, তাহলে তা একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যারই ইঙ্গিত দেয়।

এই অবস্থাটি শুধু একজনের ব্যক্তিগত যৌনজীবনের গোপন সমস্যা নয়, বরং হতে পারে নানা জটিল অসুস্থতার পূর্বাভাস—যেমন হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়বিক ব্যাধি, ডায়াবেটিস বা এমনকি ক্যান্সারের মতো সমস্যারও সম্ভাব্য সূচনা।

 

এই সমস্যা কীভাবে শরীরের ভেতরের বার্তা দেয়?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরেকটাইল ডিসফাংশন অনেক সময় দেহের রক্তনালীর সমস্যার প্রথম প্রকাশ। পুরুষাঙ্গে দৃঢ়তা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও সাবলীল রক্ত সঞ্চালন। যখন ছোট রক্তনালীগুলো সংকুচিত বা ব্লক হয়ে যায়, তখন প্রথম প্রভাব পড়ে পুরুষাঙ্গে। এর পেছনে থাকতে পারে—

☞ হৃদযন্ত্রের সমস্যা (Coronary Artery Disease)

☞ রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ (Diabetes Mellitus)

☞ Testosterone হরমোনের ঘাটতি

☞ Obesity বা অতিরিক্ত ওজন

☞ ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন

☞ নিদ্রাহীনতা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন
 

এই সমস্যাটি কোনও একটি নির্দিষ্ট বয়সের জন্য সংরক্ষিত নয়। আধুনিক জীবনযাপনের চাপ, কাজের স্ট্রেস এবং ডিজিটাল আসক্তির কারণে এখন ২৫-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যেও ইরেকটাইল ডিসফাংশনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

 

ইডি (ED) এর কিছু লক্ষণ -

☞  যৌনতায় লিঙ্গে পূর্ণ বা পর্যাপ্ত দৃঢ়তা না আসা।

☞  লিঙ্গে দৃঢ়তা দ্রুত হারিয়ে ফেলা।

☞  যৌন উদ্দীপনার অভাব ।

☞  কম যৌন আকাঙ্ক্ষা ।

☞  যৌনতায় অসুবিধা ।

 

মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব: নীরব দুর্ভোগের কারণ

ইরেকটাইল ডিসফাংশনের একটা বড় কারণ মন। মানসিক অবসাদ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, কিংবা যৌনতা নিয়ে আতঙ্ক—এসবই যৌন উত্তেজনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আজকের কর্মব্যস্ত জীবনে অনেক পুরুষ বাইরে সফল হলেও ভেতরে নীরব যন্ত্রণায় ভোগেন, যা তারা কাউকে বলতে পারেন না।

 

চিকিৎসা আছে, কিন্তু চুপ করে থাকলে সমাধান নেই

অনেকেই এই সমস্যাকে 'লজ্জার' বলে এড়িয়ে যান, অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন রয়েছে  একাধিক সমাধান -

⇨ লাইফস্টাইল পরিবর্তন: প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটা, ঘুম ঠিক রাখা, ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করা।

⇨ মেডিক্যাল থেরাপি: হরমোনের ভারসাম্য পরীক্ষা ও প্রয়োজনে ওষুধ ব্যবহার।

⇨ সাইকোসেক্সুয়াল কাউন্সেলিং: মানসিক কারণ থাকলে উপযুক্ত পরামর্শ ও থেরাপি।

⇨ নতুন প্রযুক্তি ও থেরাপি: Shockwave therapy, penile implant—বিশ্বব্যাপী এখন আরও উন্নত চিকিৎসাও রয়েছে।

ইডি (ED)  সমস্যার আধুনিক, নিরাপদ ও স্থায়ী চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে নিচের থেরাপিগুলো বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে বিবেচিত:

১. শকওয়েভ থেরাপি (Shockwave Therapy): এই চিকিৎসায় ৬ থেকে সর্বোচ্চ ১২টি সেশন গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে একটি করে সেশন দেয়া হয়। ৩ থেকে ৪টি সেশন নেওয়ার পরেই রোগী নিজেই উন্নতির পার্থক্য বুঝতে পারবেন। লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।

২. আকুপাংচার থেরাপি (Acupuncture Therapy): এই থেরাপির মাধ্যমে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, যার ফলে লিঙ্গে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং তা শক্ত হতে সহায়তা করে।

৩. পেলভিক স্টিমুলেটর (Pelvic Stimulator): এই যন্ত্রের মাধ্যমে পেলভিক ফ্লোর মাসলের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার মতো সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়।

৪. আরটিএমএস (rTMS - Repetitive Transcranial Magnetic Stimulation): দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তার কারণে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এই থেরাপির মাধ্যমে রাতে ঘুমের মান উন্নত হয়, ফলে শরীরে সেক্সুয়াল হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে।

এই সব থেরাপিই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরীক্ষিত এবং ক্লিনিক্যাল প্র‍্যাকটিসে শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত, যা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ সমাধান প্রদান করে।
 

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—প্রথমে সমস্যাটি স্বীকার করা এবং সময়মতো একজন প্রফেশনাল স্বাস্থ্য পরামর্শদাতার সঙ্গে কথা বলা।
 

সমাজ ও সচেতনতার দায়

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও এমন যে, ED মানেই পুরুষত্বহীনতা। অথচ বাস্তবে এটি একটি চিকিত্সাযোগ্য মেডিক্যাল কন্ডিশন। গবেষণা বলছে, প্রতিটি দশজন পুরুষের মধ্যে অন্তত চারজন জীবনের কোনো না কোনো সময় এ সমস্যায় ভোগেন। তবুও মাত্র ২৫% চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। বাকিরা চুপ থাকেন, অবজ্ঞা করেন বা ভুল তথ্যে ভরসা রাখেন।

ইরেকটাইল ডিসফাংশন কোনো ত্রুটি নয়, এটি এক ধরনের 'বডি সিগন্যাল'—যা হয়তো বড় কোনো স্বাস্থ্য জটিলতার আগাম বার্তা। সময়মতো চিকিৎসা, সচেতনতা, সঠিক জীবনধারা এবং মনোযোগই পারে এ সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে।

আর সবচেয়ে বড় কথা—এটা লজ্জার নয়, বরং সচেতনতাই ভবিষ্যৎকে সুস্থ ও পূর্ণ করে তুলতে পারে।


সম্পর্কিত নিউজ