আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নয়-রকেট ছাড়াও মহাকাশে ছুটবে মানুষ!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মহাকাশে আমাদের যাত্রা এখন আর শুধুই রকেট নির্ভর নয়—বিকল্প প্রপালশন প্রযুক্তিগুলোর অগ্রগতি দেখাচ্ছে ভবিষ্যতের ভিন্ন গতি-ছন্দ। গ্রহান্তরে পৌঁছাতে সপ্তাহ নয়, হতে পারে দিন; এমনকি আলো গতির কাছাকাছি পৌঁছানোর স্বপ্নও অতি দুরের নয়।
বর্তমানে প্রচলিত কেমিক্যাল রকেট প্রযুক্তি যেমন স্পেস এক্স-এর ফ্যালকন বা নাসার স্পেস লঞ্চ সিস্টেম দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রায় সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে—বিশেষ করে জ্বালানি ও গতি। এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে বিজ্ঞানীরা তাকিয়ে আছেন রকেটের বাইরে থাকা প্রযুক্তিগুলোর দিকে।
আয়ন থ্রাস্টার: বিদ্যুৎ-চালিত ধ্রুব গতি
আয়ন থ্রাস্টার (Ion Thruster) প্রযুক্তি হচ্ছে মহাকাশযানকে ইলেকট্রিক্যালি চার্জ করা আয়ন গ্যাসকে বের করে, ধীর গতিতে কিন্তু দীর্ঘ সময়ে ক্রমাগত ত্বরিত করার পদ্ধতি। NASA এর Dawn মিশন এটি সফলভাবে ব্যবহার করেছে, যা অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের দুই গ্রহাণু ভেস্টা ও সেরিসে গিয়েছিল।
এই প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হচ্ছে—খুবই কম জ্বালানি খরচে, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। বর্তমান আয়ন থ্রাস্টার প্রযুক্তি দিয়ে একটি মহাকাশযান প্রতি সেকেন্ডে মাত্র কয়েক মিলিমিটার গতি বাড়াতে পারে, কিন্তু কয়েক মাস বা বছর ধরে এটি চালিয়ে গেলে মোট গতি লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পায়।
পরবর্তী দশকে শক্তিশালী আয়ন থ্রাস্টার যেমন 'NEXT-C' (NASA's Evolutionary Xenon Thruster – Commercial) প্রযুক্তি আরও দ্রুত এবং বেশি স্থায়ী হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি বৃহদায়তন গ্রহান্তর অভিযানে যেমন মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি বা আরও দূরের স্থানগামী মিশনে বিপ্লব ঘটাবে।
নিউক্লিয়ার প্রপালশন: শক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহার
নিউক্লিয়ার প্রপালশন মূলত দুটি প্রধান ধরনে বিভক্ত—নিউক্লিয়ার থার্মাল এবং নিউক্লিয়ার ইলেকট্রিক। নিউক্লিয়ার থার্মাল প্রযুক্তিতে, নিউক্লিয়ার রিএক্টরে সৃষ্ট তাপ দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস উত্তপ্ত করে তা থেকে উৎপন্ন তাড়না ব্যবহার করা হয়। এটি প্রচলিত কেমিক্যাল রকেটের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ শক্তিশালী।
নিউক্লিয়ার ইলেকট্রিক প্রপালশন প্রযুক্তিতে নিউক্লিয়ার শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়, যা আয়ন থ্রাস্টারের মতো ইলেকট্রিক প্রপালশনে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে জ্বালানির দক্ষতা এবং গতি দুটোই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়।
NASA এবং DARPA বর্তমানে 'DRACO' (Demonstration Rocket for Agile Cislunar Operations) প্রকল্পে কাজ করছে। ২০২৭ সালের মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক নিউক্লিয়ার থার্মাল রকেট উৎক্ষেপণ পরিকল্পিত। এর মাধ্যমে চাঁদ এবং মঙ্গলের মধ্যে দ্রুত গমনাগমন সম্ভব হবে।
ওয়ার্প ড্রাইভ: ভবিষ্যতের তত্ত্ব থেকে বাস্তবের পথে
ওয়ার্প ড্রাইভ বা স্পেসটাইম ম্যানিপুলেশন ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী মিগুয়েল আলকুবিয়েরে। ধারণাটি হল মহাকাশের স্থান ও সময়কে এমনভাবে বাঁকানো, যাতে স্পেসক্রাফ্ট নিজে গতি না বাড়িয়ে বরং মহাকাশ-সময়কে সংকুচিত বা প্রসারিত করে যাত্রার গতি বৃদ্ধি পায়।
এই প্রযুক্তির জন্য প্রচুর শক্তি ও অদ্ভুত পদার্থের প্রয়োজন হবে, যেগুলো এখনো আবিষ্কৃত হয়নি বা প্রস্তুত নয়। তবু, বিজ্ঞানীরা থিওরেটিক্যাল মডেল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই ধারণাকে পর্যালোচনা করছেন। যদি সফল হয়, তাহলে কয়েক দশকে মানবজাতির প্রথম আলোকবর্ষ পাড়ি দেওয়া যাত্রা শুরু হতে পারে।
অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রপালশন:
◑ বিয়াম থ্রাস্টার (Beam-powered propulsion): এখানে মহাকাশযান নিজেই শক্তি বহন না করে, ভূপৃষ্ঠ থেকে লেজার বা মাইক্রোওয়েভ বীমের মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করে। এটি অপেক্ষাকৃত কম ওজনের মহাকাশযান দ্রুত চালানোর সম্ভাবনা রাখে।
◑ সোলার সেল-চালিত ইলেকট্রিক থ্রাস্টার: সূর্যের আলোর শক্তি কাজে লাগিয়ে আয়ন বা প্লাজমা থ্রাস্টার চালানো, যা সৌরজগতের ভিতরে দীর্ঘমেয়াদি মিশনে ব্যবহৃত হতে পারে।
মহাকাশ এখন শুধুমাত্র রকেটের উপর নির্ভর নয়। গতির গাণিতিক সূত্র ও শক্তির আধুনিক পুনর্ব্যাখ্যায় জন্ম নিচ্ছে এক নতুন মহাকাশ-যুগ। যে যুগে মঙ্গল নয়, হয়তো কয়েক দশকের মধ্যে মানুষের চোখ পড়বে গ্যাস জায়ান্ট বা তাদের উপগ্রহগুলোতেও। এই সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে প্রপালশন প্রযুক্তির এই নবযাত্রা—নীরব, ধ্রুব, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পরিশীলিত।