নারীদের স্মৃতিভ্রষ্টতার নেপথ্যে বিষণ্নতার গভীর ছায়া

নারীদের স্মৃতিভ্রষ্টতার নেপথ্যে বিষণ্নতার গভীর ছায়া
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন শুধু মানসিক কষ্ট নয়—এটি একটি সুস্পষ্ট নিউরোবায়োলজিক্যাল সমস্যা, যার প্রভাব সরাসরি পড়ে মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতায়। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো জানাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতায় আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন বিষণ্নতা তিন মাস বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়।

একাধিক নিউরোসায়েন্টিফিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিপ্রেশনে ভোগা নারীদের মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাস নামক অঞ্চলের আকার ছোট হয়ে যায়। এই অংশটি দায়ী নতুন তথ্য গ্রহণ, স্মৃতি গঠন ও শেখার জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় বিষণ্নতায় থাকলে স্ট্রেস হরমোন 'কর্টিসল'-এর মাত্রা বেড়ে যায়, যা হিপোক্যাম্পাসের নিউরোনাল কোষে ক্ষতি সাধন করে। ফলে স্মৃতি গঠনের প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং অতীত ঘটনা মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
 

এই প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় 'অটোবায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরি' বা আত্মজীবনীভিত্তিক স্মৃতিতে-যেখানে ব্যক্তি নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোর কথা ভুলতে শুরু করেন। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত নারীরা অনেক সময় তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-যেমন শেষ ছুটি কবে নিয়েছেন, পরিবারের কার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, এমনকি অফিসের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন-এসব তথ্য ভুলে যান বা অস্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন।
 

বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীরা হরমোনজনিত ওঠানামা (যেমন মাসিক চক্র, গর্ভধারণ ও মেনোপজ) এবং সামাজিক চাপের সম্মুখীন বেশি হন। এ কারণেই তারা পুরুষদের তুলনায় বিষণ্নতার ঝুঁকিতে অনেক বেশি এবং এর জৈবিক প্রভাবও তাদের মধ্যে বেশি প্রকাশ পায়। হরমোন ও কর্টিসলের জটিল আন্তঃক্রিয়াই এ ধরনের নিউরোবায়োলজিক্যাল পরিবর্তনের মূলে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
 

তবে এই প্রভাব কেবল স্মৃতিশক্তি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বিষণ্নতা দীর্ঘস্থায়ী হলে একাধিক কগনিটিভ ফাংশন-যেমন মনোযোগ ধরে রাখা, সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত নেওয়া ও ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা-এসবেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কিশোরী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারী-সকল স্তরেই এই মানসিক স্বাস্থ্য সংকট কর্মক্ষমতা ও জীবনমানের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
 

এই বাস্তবতা সামনে এনে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে শরীরের স্বাস্থ্যের চেয়ে কম গুরুত্ব দিলে চলবে না। নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা। তাই চিকিৎসা, থেরাপি, সামাজিক সহায়তা এবং সচেতনতা-এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়াতে হবে সুস্থ মস্তিষ্ক গঠনের আন্দোলন।
 

স্মৃতিশক্তির ক্ষয় রোধে বিজ্ঞানীরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন-যেমন, প্রতিদিন নিয়মিত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা), মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ধ্যান বা মেডিটেশন, ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাদ্য ও সামাজিক সংযোগ বজায় রাখা। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং ও থেরাপি নেওয়া এবং প্রাথমিক অবস্থায় সমস্যাকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ।
 

বিষণ্নতা আজকের দিনে গোপন যন্ত্রণার নাম হলেও এর প্রতিকার সম্ভব, যদি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একযোগে এগিয়ে আসে। একজন নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝতে পারলে পুরো সমাজই আরও বেশি মানবিক, দক্ষ এবং কার্যকর হয়ে উঠবে-এটা শুধু একটি স্বাস্থ্যগত দাবি নয়, বরং একটি সামষ্টিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা।


সম্পর্কিত নিউজ