ওপেন সোর্স বদলাচ্ছে প্রযুক্তির নিয়মকানুন ও নেতৃত্ব

ওপেন সোর্স বদলাচ্ছে প্রযুক্তির নিয়মকানুন ও নেতৃত্ব
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একটি সময়ে সফটওয়্যার মানেই ছিল গোপন কোড, পেটেন্ট সুরক্ষা, এবং সাধারণ ব্যবহারকারীর চোখের আড়ালে থাকা একটি কালো বাক্স। আজ, সেই দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি-চেতনা—Open Source Software বা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার—জগতজোড়া সহযোগিতা, উদ্ভাবন এবং স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠছে।

এই সফটওয়্যার কেবল বিনামূল্যে পাওয়া কোড নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মডেল—যেখানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ প্রযুক্তি গঠনে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেটি পরিবর্তন করতে পারে, এমনকি নিজেই আরও উন্নত কিছু নির্মাণ করতে পারে।
 

ওপেন সোর্স: শুধু কোড নয়, একটি দার্শনিক আন্দোলন

"Free as in freedom, not just free as in price"-এটি ওপেন সোর্স দর্শনের মূলমন্ত্র। অর্থাৎ এটি কেবল খরচহীন নয়, বরং স্বাধীনভাবে ব্যবহার, পরিবর্তন ও বিতরণযোগ্য।

এই ধারণাটি এসেছে ১৯৮০'র দশকে, যখন সফটওয়্যার দুনিয়ায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। সেই প্রতিক্রিয়া হিসেবে রিচার্ড স্টলম্যান প্রতিষ্ঠা করেন Free Software Foundation, আর পরবর্তীতে 'open source' শব্দটি জনপ্রিয়তা পায়। আজ এটি বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ প্রকল্পের ভিত্তি।
 

বৈশ্বিক প্রভাব: কোটি কোটি ডলার মূল্যের ইকোসিস্টেম

⇨  অর্থনীতি: ওপেন সোর্স সফটওয়্যার এখন একটি বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। Red Hat (IBM-এর অংশ), GitHub (Microsoft অধিভুক্ত), Docker, GitLab—এসব প্রতিষ্ঠান ওপেন সোর্স মডেলে গড়ে ওঠা সফল বাণিজ্যিক উদ্যোগ।

⇨  ডেটা ও গবেষণা: OpenStreetMap, Jupyter Notebooks, SciPy, R Language—এসব ওপেন টুল ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা পর্যন্ত চলছে।

⇨  ক্লাউড কম্পিউটিং: Kubernetes, Docker, Terraform, Prometheus—সব ওপেন সোর্স। এগুলো ছাড়া আধুনিক ক্লাউড সেবা কল্পনাও করা যায় না।

⇨  মোবাইল এবং ওয়েব: Android-এর ভিত্তি ওপেন সোর্স Linux Kernel। Web Browser হিসেবে Firefox, Chromium (Google Chrome এর ভিত্তি), Brave ইত্যাদির ভিত্তিও ওপেন কোড।

 

নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: গোপন নয়, গ্লোবাল পার্টনারশিপ

অনেকের মনে ধারণা—"উন্মুক্ত কোড মানেই ঝুঁকি বেশি।" বাস্তবে, এটি উল্টো।

⇨  Auditability: যেহেতু কোড সবার কাছে উন্মুক্ত, সুরক্ষা বিশ্লেষকরা সহজেই নিরাপত্তা ত্রুটি শনাক্ত করতে পারেন।

⇨  কমিউনিটি রিভিউ: হাজার হাজার অভিজ্ঞ ডেভেলপার প্রতিদিন কোড পর্যালোচনা করছে, যা বাগ ধরার সুযোগ বাড়ায়।

⇨  দ্রুত আপডেট: প্রচলিত সফটওয়্যার যেখানে নিরাপত্তা প্যাচে সময় নেয়, ওপেন সোর্স সেখানে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেয়।

বিশ্বের সাইবার নিরাপত্তা গবেষণায় আজ GitHub, Apache Foundation, Linux Foundation-এর ওপেন সোর্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।

 

শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব

বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি ইনস্টিটিউট, এবং কোডিং একাডেমিগুলো এখন ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাস্তব শিক্ষা দিচ্ছে।

⇨  শিক্ষার্থীরা GitHub, GitLab, VS Code, Arduino, Blender, GIMP ইত্যাদি সফটওয়্যারে কাজ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করছে।
 

⇨   ওপেন সোর্সের জন্য এখন শেখার খরচ কমেছে; 'One Laptop per Child', 'Raspberry Pi' প্রজেক্ট—সবচেয়ে কম দামে শিক্ষাকে ডিজিটাল করে তুলেছে।
 

⇨  বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে সফটওয়্যার লাইসেন্স কেনার সামর্থ্য সীমিত, ওপেন সোর্স সেখানে একটি বাস্তব ও টেকসই বিকল্প।
 

সরকারের জন্য সম্ভাবনা: স্বনির্ভরতা ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব

অনেক দেশ আজ Digital Sovereignty অর্থাৎ ডিজিটাল স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে ওপেন সোর্সকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

জার্মানি, ফ্রান্স, চীন এবং ভারত সরকারি প্রতিষ্ঠানে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহারে নীতি গ্রহণ করেছে। এতে করে একদিকে যেমন খরচ কমে, তেমনি প্রযুক্তির ওপর বিদেশি নির্ভরতা হ্রাস পায়।

বাংলাদেশেও E-Government, স্বাস্থ্য তথ্য, শিক্ষাপ্রযুক্তি এবং সাইবার সিকিউরিটি খাতে ওপেন প্ল্যাটফর্ম গ্রহণ করা হলে দীর্ঘমেয়াদী দক্ষতা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব।

 

ভবিষ্যৎ কি ওপেন?

ওপেন সোর্স শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তির ভিত্তি। AI (Artificial Intelligence), Blockchain, Internet of Things (IoT)-প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওপেন সোর্স একক বা সম্মিলিতভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

প্রখ্যাত AI মডেল Hugging Face, Meta'র LLaMA, Google-এর TensorFlow, OpenAI-এর Gym-সব ওপেন সোর্স।

এতে করে এআই গবেষণার গতিও বাড়ছে, এবং উন্নয়নশীল দেশের গবেষকরাও এতে অংশ নিতে পারছেন।
 

প্রযুক্তি হোক অংশগ্রহণমূলক

ওপেন সোর্স আমাদের সামনে একটি শক্ত বার্তা তুলে ধরে - প্রযুক্তির মালিকানা কেবল বড় কর্পোরেটদের নয়; সাধারণ মানুষের হাতেও থাকতে পারে ভবিষ্যৎ গঠনের চাবিকাঠি।

এটি কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। বরং প্রতিদিন লক্ষ প্রোগ্রামার, শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা - সবাই মিলে এই বিপ্লব গড়ে তুলছেন।

এই সফটওয়্যার কেবল একটি কোডভিত্তিক যন্ত্র নয়, বরং এটি প্রযুক্তি ব্যবহারের গণতান্ত্রিক পথ।


সম্পর্কিত নিউজ