প্রকৃতির পাতায় লেখা চিকিৎসার গোপন ফর্মুলা

প্রকৃতির পাতায় লেখা চিকিৎসার গোপন ফর্মুলা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত উন্নতির ঝড় বইলেও, এক টুকরো পাতা, এক মুঠো ছাল বা একফোঁটা নির্যাস-আজও বহু অসুখের প্রকৃত উপশম হতে পারে গাছের মধ্যেই। ঔষধি উদ্ভিদের গুরুত্ব নতুন নয়, তবে আজকের বৈশ্বিক স্বাস্থ্যচাহিদা, পরিবেশগত সচেতনতা ও জৈব প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে এটি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে।

একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ হাটে, বাড়ির পাশে কিংবা বনের ধারে ছড়িয়ে থাকা গাছই ছিল মানুষের একমাত্র চিকিৎসা ভরসা। আজ, সেই লোকজ চিকিৎসার পেছনের বিজ্ঞান খুঁজে পেতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ওষুধের প্রায় ২৫ শতাংশ সরাসরি উদ্ভিদ-উৎস থেকে উৎপাদিত, এবং এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে যদি অব্যবহৃত ঔষধি গাছগুলোর সক্রিয় উপাদানগুলো নিয়ে গভীর গবেষণা চালানো হয়।

বর্তমানের বহুল ব্যবহৃত ক্যান্সারবিরোধী ওষুধ যেমন Taxol (Paclitaxel), আসে Taxus brevifolia নামে পরিচিত এক ধরনের ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছ থেকে। ম্যালেরিয়ার অন্যতম কার্যকর ওষুধ Artemisinin এসেছে Artemisia annua গাছ থেকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫০০টির বেশি ঔষধিগাছ সনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোর চিকিৎসা উপযোগী গুণাগুণ রয়েছে।

তুলসী, নিম, বাসক, গুড়িচ, অর্জুন, অশ্বগন্ধা, বহেরা, হরীতকী, পাথরকুচি, বন-ধনে, কালমেঘ—এসব উদ্ভিদ শুধু লোকজ চিকিৎসায় নয়, এখন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারেও প্রমাণ দিচ্ছে নিজেদের কার্যকারিতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাছের মধ্যে থাকা "ফাইটো-কেমিক্যালস" বা উদ্ভিদ-উৎপন্ন রাসায়নিক যৌগ যেমন আলকালয়েড, ফ্ল্যাভোনয়েড, ট্যানিন ও টারপেনয়েড-এসবই হলো প্রাকৃতিক চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

উদাহরণস্বরূপ, কালমেঘে রয়েছে অ্যান্ড্রোগ্রাফোলাইড, যা প্রদাহ ও ভাইরাল সংক্রমণ কমাতে কাজ করে। এছাড়া গুলঞ্চ গাছের মূল থেকে প্রাপ্ত বারবেরিন যৌগটি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ডায়াবেটিক গুণসম্পন্ন।

বর্তমানে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের নির্দিষ্ট ঔষধি উপাদানগুলোর কার্যকারিতা, প্রভাব, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিপাকক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালাচ্ছেন। এই গবেষণাগুলো শুধুমাত্র ঔষধ তৈরিতে নয়, গাছের চাষের পদ্ধতি উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
 

টেকসই চিকিৎসার দিকনির্দেশনা

বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এখন পরিবেশবান্ধব ও কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন ওষুধ তৈরির দিকে ঝুঁকছে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎস থেকে নেওয়া বায়োঅ্যাকটিভ যৌগই হচ্ছে প্রধান ভরসা।

বাংলাদেশে কৃষিজমিতে ভেষজ চাষ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, এবং নীতিগত সুরক্ষার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী 'গ্রিন মেডিসিন ইকোনমি' গড়ে তোলা সম্ভব। এতে যেমন গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হবে, তেমনই দেশে কম খরচে কার্যকর ওষুধ উৎপাদন সম্ভব হবে।
 

বিপদের মুখেও ভেষজ সম্পদ

তবে এই আশাবাদের মাঝেও রয়েছে বড় একটি শঙ্কা। বন উজাড়, ভূমি দূষণ, নির্বিচারে কীটনাশকের ব্যবহার এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় অনেক ঔষধি গাছ বিলুপ্তির পথে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫,০০০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ আজ হুমকির মুখে বলে জানাচ্ছে একাধিক পরিবেশ সংগঠন।
 

প্রকৃতির গাছপালা শুধু সৌন্দর্যের উৎস নয়, এগুলো আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং ওষুধশিল্পের ভবিষ্যৎও গঠনে সক্ষম। গাছের পাতা, ছাল, মূল ও ফল-এইসব অংশে যে বিশাল চিকিৎসাবিজ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে, তাকে উদ্ঘাটন এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব আজ আমাদের সবার। গাছ কেটে নয়, গাছ চিনে-সেই জ্ঞানেই রয়েছে সুস্থতার সবচেয়ে প্রাচীন ও কার্যকর চাবিকাঠি।


সম্পর্কিত নিউজ