স্পেস ডেব্রি - উড়ন্ত বর্জ্যের ফাঁদে পৃথিবীর কক্ষপথ

স্পেস ডেব্রি -  উড়ন্ত বর্জ্যের ফাঁদে পৃথিবীর কক্ষপথ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মহাকাশ এখন আর নিছক এক নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক বিশালাকার 'জঞ্জালের আকাশ'। পৃথিবীর কক্ষপথে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে হাজার হাজার পরিত্যক্ত স্যাটেলাইট, রকেটের ধ্বংসাবশেষ, রঙিন স্ক্রু থেকে শুরু করে বিশাল ধাতব টুকরো পর্যন্ত—সবকিছুর সামষ্টিক রূপই আজকের স্পেস ডেব্রি। এ বর্জ্য শুধু মহাকাশ অভিযানে বাধা নয়, বরং হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, এমনকি মহাকাশে মানব উপস্থিতির জন্যও।

স্পেস ডেব্রি: কী এবং কতটা ভয়ংকর?

বর্তমানে প্রায় ৩৪,০০০ বড় আকারের (১০ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড়) ডেব্রি টুকরো, এবং ১০০ মিলিয়নের বেশি ক্ষুদ্র কণিকা পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তথ্যটি নিশ্চিত করেছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA)। ঘণ্টায় প্রায় ২৭,০০০ কিমি গতিতে চলা এই ধ্বংসাবশেষগুলোর যেকোনোটি সচল স্যাটেলাইট বা মহাকাশযানে আঘাত হানতে পারে, যার ফল হতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

২০১৩ সালে চীনের একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস হয়ে যায় স্পেস ডেব্রির সঙ্গে সংঘর্ষে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) প্রায়শই সতর্ক অবস্থায় চলে যেতে বাধ্য হয়, ডেব্রির সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে। এমনকি ২০২১ সালে, রাশিয়ার একটি অ্যান্টি-স্যাটেলাইট টেস্টের ফলে সৃষ্টি হওয়া ধ্বংসাবশেষ নিয়ে একাধিক সতর্কতা জারি করা হয়।
 

এই বিপদ কেন গুরুত্ব পাচ্ছে এখন?

মহাকাশ বাণিজ্য, উপগ্রহ নির্ভরতা, এবং মহাকাশ পর্যটনের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ পৃথিবীর কক্ষপথকে আরও ব্যস্ত করে তুলছে। ফলে প্রতিটি সেকেন্ডে সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়ছে বহুগুণ। উপরন্তু, Kessler Syndrome নামে পরিচিত এক বিজ্ঞানভিত্তিক আশঙ্কা রয়েছে—যেখানে স্পেস ডেব্রির মধ্যে সংঘর্ষ থেকে আরও ডেব্রি তৈরি হয়ে এক সময় মহাকাশকে প্রায় অচল করে তুলতে পারে।
 

সমাধানের পথ: মহাকাশ পরিষ্কারের অভিযান

বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাগুলো স্পেস ডেব্রি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম:

ClearSpace-1 (ESA): ২০২6 সালে চালু হতে যাওয়া এই মিশনে একটি রোবোটিক বাহু দিয়ে একটি পরিত্যক্ত অংশকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে।

RemoveDEBRIS (UK): জাল, হারপুন এবং ড্র্যাগ সেল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডেব্রি ধরার এক পরীক্ষামূলক মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

Astroscale (Japan): একটি বাণিজ্যিক সংস্থা যেটি সচল ও অচল স্যাটেলাইটকে ট্র্যাক করে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় কাজ করছে।

 

টেকসই সমাধান: ভবিষ্যতের কৌশল কী হওয়া উচিত?

⇨ "Design for Demise": স্যাটেলাইট ডিজাইন করার সময়ই এমনভাবে তৈরি করা, যাতে তারা নিজেরাই নির্ধারিত সময়ের পর ধ্বংস হয়ে যায়।

⇨ "Active Debris Removal": নিয়মিত মহাকাশ মিশনের মাধ্যমে বড় ডেব্রি অংশ সরানো।

⇨ "International Policy Framework": বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে একক নীতিমালা, যাতে নতুন মিশনগুলোতে বাধ্যতামূলক ডেব্রি ব্যবস্থাপনা গৃহীত হয়।

 

মহাকাশে প্রবেশ এখন আর শুধু আবিষ্কারের ব্যাপার নয়, এটি টিকে থাকার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি, জিপিএস, আবহাওয়া পূর্বাভাস থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত—সবকিছু এখন স্যাটেলাইট নির্ভর। তাই স্পেস ডেব্রি যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে একদিন এই 'আকাশের আবর্জনা'ই হয়ে উঠতে পারে প্রযুক্তির শেষ অন্তরায়।

তথ্যসূত্র: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA), নাসা, জাতিসংঘ অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্স (UNOOSA) ও ওপেন অ্যাক্সেস রিসার্চ রিপোর্ট।


সম্পর্কিত নিউজ