কুরবানি ও তাকওয়া: আত্মত্যাগের প্রকৃত অর্থ কী?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঈদুল আজহা / কুরবানির ঈদ শুধু পশু জবাইয়ের উৎসব নয়; এটি মূলত একটি আত্মিক পরীক্ষার নাম—যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করাই হলো আসল শিক্ষা। ইসলামের দৃষ্টিতে কুরবানির আসল তাৎপর্য হলো তাকওয়া—অর্থাৎ আল্লাহভীতি ও আনুগত্য।
➤ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
কুরবানি শব্দের অর্থ হলো নিকটবর্তী হওয়া। ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নিয়মে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করাকেই কুরবানি বলা হয়। এটি শুরু হয়েছিল হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর ঘটনা থেকে, যখন ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনে তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কুরবানি দিতে উদ্যত হন। কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর তাকওয়া দেখে ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কোরবানির মহত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান:
لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنكُمْ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدىٰكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ـ
অর্থাৎ 'কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং কোরবানির মধ্য দিয়ে তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারী বা আল্লাহভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছে। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন—যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা কর। এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।' (সুরা হজ: ৩৯)
- এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন—কুরবানির বাহ্যিক রূপের চেয়ে বেশি গুরুত্ব রয়েছে আমাদের অন্তরের নিয়ত ও খোদাভীতির উপর। অর্থাৎ, কুরবানি হলো আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা, আনুগত্য এবং সর্বোচ্চ ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম।
➤ঐতিহাসিক উৎস: হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর তাকওয়ার চূড়ান্ত নিদর্শন
কুরবানির পেছনে যে কাহিনীটি প্রতীক হয়ে আছে তা হলো হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর বিস্ময়কর আত্মত্যাগ। যখন ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ পান নিজ সন্তানকে কুরবানি করার, তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেই আদেশ পালন করতে উদ্যত হন। এই ঘটনা শুধুই এক পিতা ও পুত্রের আত্মোৎসর্গ নয়—এটি ছিল তাকওয়ার এমন এক উজ্জ্বল উদাহরণ যা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
ইব্রাহিম (আ.) বলেছিলেন: "হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে কুরবানি করছি। তুমি বলো, তোমার কী মত?" ইসমাঈল (আ.) বলেছিলেন: "হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।" (সূরা সাফফাত ৩৭:১০২)
এটাই হলো কুরবানির সত্যিকার ব্যাখ্যা—আল্লাহর আদেশের সামনে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দেওয়ার নামই তাকওয়া।
➤ আবেগঘন বাস্তবতা:
আমাদের সমাজেও এমন অসংখ্য নিঃস্ব মানুষ রয়েছেন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় বছরের পর বছর সঞ্চয় করে কুরবানির গরু কেনেন। চট্টগ্রামের একজন বৃদ্ধ কৃষক বলেন,
"আমি নিজের খাবার কম খেয়ে একটি ছোট গরু পুষেছি, শুধু যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করতে পারি। এটিই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ।"
তাঁর কণ্ঠের কম্পনেই বোঝা যায়, কুরবানির আবেগ কতটা গভীর, কতটা পবিত্র।
➤ কুরবানি মানে শুধু জবাই নয়, বরং আত্মগঠনের মাধ্যম:
আজকের আধুনিক সময়ে কুরবানির রীতি অনেকটা বাহ্যিক প্রদর্শনীতে পরিণত হচ্ছে। বড় পশু, মহা আয়োজন, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা—এসবের মধ্যে কুরবানির আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ প্রকৃত কুরবানি হলো—নিজের অহংকার, হিংসা, হটকারিতা, অসহিষ্ণুতা, ও লোভের পশুকে 'জবাই' করা।
➤মানবিকতা ও ভাগাভাগির শিক্ষা:
ইসলাম কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দিয়েছে:
১। এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য
২। এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য
৩। এক তৃতীয়াংশ গরিব-দুঃস্থদের জন্য
এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় নির্দেশ নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও দয়ার শিক্ষা। এতে গরিবদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি হয়, সমাজে সহানুভূতি ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ইসলামী আদর্শ আজকের বৈষম্যপূর্ণ সমাজে একটি আদর্শ ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে।
কুরবানি মানে একটি পশু জবাই নয়—এটি এক চিরন্তন শিক্ষা: কিভাবে একজন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের সর্বোচ্চ স্থানে রাখে। তাকওয়া অর্জনের এই ইবাদত আমাদের শেখায়—কীভাবে নিজের ইচ্ছা ও দুনিয়ার মোহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আদেশ মেনে চলা যায়। কুরবানি যেন হয়ে উঠুক একটি আত্মিক বিপ্লব, যা বদলে দেবে আমাদের মন-মানসিকতা, চিন্তা ও সমাজকে।
আসুন, এবারের কুরবানিতে আমরা কেবল পশু নয়, আমাদের মনের অহংকার, লোভ ও হিংসাও কুরবানি করি।