ঈদুল আজহা উদযাপনে ইসলামি ঐক্য-পদ্ধতিগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিশ্ব মুসলিম সমাজ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঈদুল আজহা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করা, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের স্মরণ এবং দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণের এই উৎসব বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে এক অনন্য বন্ধন সৃষ্টি করে।
যদিও মূল উদ্দেশ্য সর্বত্র অভিন্ন, তবে কুরবানির প্রক্রিয়া, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় একেক দেশে দেখা যায় ভিন্নতা।
মধ্যপ্রাচ্য: ঐতিহ্য ও সংগঠিত ব্যবস্থাপনা
সৌদি আরবে কুরবানি সর্বোচ্চ সংগঠিতভাবে পালন করা হয়, বিশেষত হজের সময় মিনা প্রান্তরে লক্ষ লক্ষ পশু জবাই করা হয়। দেশটির সরকার 'আদাহি প্রকল্প'-এর মাধ্যমে হজযাত্রীদের হয়ে পশু কুরবানি সম্পন্ন করে এবং গোশত বিশ্বের দরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে।
আমিরাত, কাতার ও কুয়েতে আধুনিক স্লটার হাউজ ব্যবহৃত হয়। অনেকে অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে কুরবানির জন্য অর্ডার দেন, যা যথাযথ ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়া: জনসম্পৃক্ত আয়োজন
বাংলাদেশ ,ভারত ও পাকিস্তানে ঈদুল আজহার কুরবানি একটি বিশাল সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় বিধান মেনে গরু, ছাগল বা ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয় নিজ বাড়ি বা নির্ধারিত কোরবানির স্থানে। এখানে কুরবানিকে কেন্দ্র করে পারিবারিক বন্ধন, প্রতিবেশী সহানুভূতি এবং গরিবদের সাহায্যের দিকটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কুরবানির পশুর হাট বসে, যেখানে গরু, ছাগল, ভেড়া ও কখনো উট কেনাবেচা হয়। ঢাকা, করাচি, লাহোরের মতো বড় শহরে কোরবানির পরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।
আফ্রিকা: সহজ-সরল রীতি ও দানপ্রধানতা
নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, সুদানসহ অনেক আফ্রিকান দেশে কুরবানি একটি বড় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। এখানে কুরবানি পশু জবাইয়ের পর অধিকাংশ গোশত গরিব ও পাড়াপড়শিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কিছু দেশে বিদেশি এনজিও ও ইসলামি দাতব্য সংস্থাও কুরবানি কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ইউরোপ ও আমেরিকা: আইন মেনে ধর্মাচরণ
ইউরোপের দেশগুলোতে (যেমন: যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স) মুসলিমরা সাধারণত লাইসেন্সপ্রাপ্ত হালাল স্লটার হাউজে কুরবানি সম্পন্ন করে থাকেন। অধিকাংশ দেশে পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে সরকারের কড়া বিধিমালা রয়েছে। তাই অনেক মুসলিম অনলাইন কুরবানি কার্যক্রম বা দেশের বাইরে পশু জবাই করে গোশত বিতরণের পদ্ধতি বেছে নেন।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাতেও হালাল মাংসের দোকান বা মসজিদভিত্তিক কুরবানি কার্যক্রম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়োগ করে গোশত বিতরণ করা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: সমাজমুখী আয়োজন
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ঈদুল আজহা কেবল কুরবানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ সামাজিক অনুষ্ঠান। এই দুই মুসলিম প্রধান দেশে কুরবানির আয়োজন মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় কমিটি পশু সংগ্রহ, জবাই ও গোশত বিতরণ পরিচালনা করে। বিশেষত ইন্দোনেশিয়ায় "কুরবান শেয়ারিং" নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে কয়েকজন ব্যক্তি মিলে একটি গরু কোরবানি দেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্নভাবে কুরবানি পালন করলেও (কোথাও ব্যক্তিগত, কোথাও তা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, আবার কোথাও এনজিও বা মসজিদ কর্তৃক সংগঠিত) সব ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য এক —আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ এবং সমাজের দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো। ঈদুল আজহা কেবল পশু জবাই নয়, এটি ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিকতার বাস্তব প্রতিফলন।