ঘুম কম হলে, মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে!

ঘুম কম হলে, মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ঘুমের ঘাটতিকে যদি আপনি শুধু 'ক্লান্তি' বলে ভাবেন, তাহলে আপনি মস্তিষ্কের সবচেয়ে নীরব বিপর্যয়টিকে অবহেলা করছেন। ঘুম, এই সাধারণ শব্দটির পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া।

ঘুমের সময় শুধু শরীর বিশ্রাম নেয় না-ঘুমের মূল নাট্যমঞ্চ হলো আমাদের মস্তিষ্ক, যেখানে চলে লাখো কোষের ছাঁটাই, পরিষ্কার এবং পুনঃগঠনের মহাযজ্ঞ। ঘুম না হলে এই প্রক্রিয়াগুলো কেবল ভেঙেই পড়ে না, বরং তা পরিণত হয় এক আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে।
 

মস্তিষ্কের "পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি" কীভাবে কাজ করে?

ঘুমের সময় সক্রিয় হয় দুটি বিশেষ জৈবিক প্রক্রিয়া-Synaptic Pruning এবং Astrocytic Phagocytosis

⇨Synaptic Pruning: প্রতিদিন আমরা অগণিত তথ্য জমাই। মস্তিষ্ক বেছে নেয় কোন স্মৃতি দরকার আর কোনটি নয়। ঘুমের সময় অপ্রয়োজনীয় 'সিন্যাপ্স' (নিউরোনের সংযোগ) কেটে ফেলে, যেন প্রয়োজনীয় তথ্য শক্তভাবে গেঁথে যায়।

⇨ Astrocytic Activity: অ্যাস্ট্রোসাইট নামের কোষগুলো ঘুমের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ও অকার্যকর কোষ ও কোষাংশ "খেয়ে ফেলে", যা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু যেদিন ঘুম ঠিকমতো হয় না, এই প্রক্রিয়াগুলো তাদের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শুরু হয় সজীব ও কার্যকর কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালে Journal of Neuroscience-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুম বঞ্চিত ইঁদুরদের মস্তিষ্কে এসব প্রক্রিয়া এতটাই সক্রিয় হয়ে ওঠে যে তা সুস্থ কোষও খেয়ে ফেলতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা এটিকে "নিউরোনাল ক্যানিবালিজম" হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
 

মানবমস্তিষ্কে এর প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর?

মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে। ঘুমের অভাবে যেসব কোষ নষ্ট হতে শুরু করে, তা ফিরে আসে না। নিয়মিত ঘুমঘাটতির ফলে দেখা দিতে পারে-

⇨ স্মৃতিভ্রংশ ও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা

⇨ একাগ্রতার অভাব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় দুর্বলতা

⇨ মানসিক রোগের সম্ভাবনা যেমন: ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, এমনকি আলঝেইমারস

⇨ মস্তিষ্কের "ক্লিন-আপ সিস্টেম" লিম্ফ্যাটিক ফাংশনের ব্যাঘাত

⇨ নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়ে আচরণগত পরিবর্তন
 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬ ঘণ্টার কম ঘুম দীর্ঘ মেয়াদে মস্তিষ্ককে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেয়, যা নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজঅর্ডারের দিকেই এগিয়ে যায়।
 

 বয়সভেদে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা -

 ☞  নবজাতক (০-৩ মাস):

১।  দৈনিক ঘুমের পরিমাণ ১৪-১৭ ঘণ্টা।

২।  মস্তিষ্ক ও শরীরের দ্রুত বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

৩।  মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগ গঠন ও শক্তিশালীকরণে সাহায্য করে।
 

☞ শিশু (৪-১১ মাস):

১। দৈনিক ১২-১৫ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

২। শেখা ও স্মৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে।
 

☞ ছোট বাচ্চা (১-২ বছর):

১। দৈনিক ১১-১৪ ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য।

২। শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন।

৩। আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করে।
 

☞ প্রাকবিদ্যালয় বয়সী (৩-৫ বছর):

১। ১০-১৩ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

২। সৃজনশীলতা ও সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক।

৩। শারীরিক ও মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়।
 

☞ স্কুলবয়সী শিশু (৬-১৩ বছর):

১। দৈনিক ৯-১১ ঘণ্টা ঘুম আদর্শ।

২। শিক্ষা গ্রহণ ও মনোযোগ ধরে রাখার জন্য জরুরি।

৩। আচরণগত উন্নতি এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
 

☞ কিশোর (১৪-১৭ বছর):

১। ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম দরকার।

২। আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।

৩। মস্তিষ্কের পুনর্গঠন ও শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রাখে।
 

☞ প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬৪ বছর):

১। দৈনিক ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

২। স্মৃতি শক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বজায় রাখে।

৩। মানসিক চাপ কমায় এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
 

☞ বয়স্ক (৬৫ বছর ও এর বেশি):

১। ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

২। স্মৃতিশক্তি রক্ষা ও দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৩। ঘুমের গুণগত মান বজায় রাখাও জরুরি, কারণ ঘুমের দৈর্ঘ্য কমে যেতে পারে।
 

অনিয়মিত শিডিউল, স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময়, রাতজাগা কাজের চাপে আজকের সমাজে ঘুম যেন বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। অথচ, এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 'মেন্টাল রিসেট' প্রক্রিয়া।
 

➤ ঘুমকে পুনরুদ্ধারের জন্য করণীয়:

⇨ ঘুমানোর সময় ও ওঠার সময় নির্দিষ্ট রাখুন

⇨ ঘুমানোর আগে স্ক্রিন টাইম কমান

⇨ ক্যাফেইন ও ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন সন্ধ্যার পর

⇨ রাতে ঘর অন্ধকার ও নিরিবিলি রাখুন

⇨ দিনের আলোতে কিছু সময় কাটান-সার্কাডিয়ান রিদম ঠিক রাখতে
 

ঘুম শুধু বিশ্রামের মাধ্যম নয়-এটি মস্তিষ্কের আত্মরক্ষার অস্ত্র। এটি আমাদের চিন্তা, স্মৃতি, এবং মানসিক স্থিতি বজায় রাখার প্রধান শর্ত। ঘুমকে অবহেলা করা মানে ধীরে ধীরে নিজের মস্তিষ্ককে ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলা। তাই, ঘুমের ঘাটতি মানে শুধু কাজের ব্যাঘাত নয়, এটা হতে পারে একদিন আপনার স্নায়ুবিক অস্তিত্ব হারানোর শুরু।
 

তথ্যসূত্র (নির্ভরযোগ্য গবেষণার ভিত্তিতে):

⇨ Journal of Neuroscience (2017): "Sleep loss promotes glial phagocytic activity and neuronal loss"

⇨ National Sleep Foundation Guidelines

⇨ WHO Sleep & Mental Health Reports


সম্পর্কিত নিউজ