হেরনিয়া - যে সমস্যাকে আমরা 'হাঁড় বের হওয়া' ভেবে বসে থাকি, কিন্তু বিজ্ঞান বলে অন্য কথা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
শরীরে কোনো ফোলা দেখা গেল - অনেকেই বলেন "হাঁড় বেরিয়ে গেছে!" কিন্তু আপনি কি জানেন, এই কথার আড়ালে থাকতে পারে এমন একটি রোগ, যা চুপিচুপি শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বের করে আনছে? বিজ্ঞানের ভাষায় এটি হলো হেরনিয়া (Hernia) - একটি নীরব অথচ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা সময়মতো ধরা না পড়লে জীবনঘাতী হতে পারে।
➤ হেরনিয়া: ভুল ধারণা থেকে শুরু
গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরেও অনেকে মনে করেন, শরীরের কোনো অংশ ফুলে উঠলে সেটা বুঝি "হাঁড় বেরিয়ে গেছে।" বাস্তবতা হলো, এখানে হাড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ফোলাভাব আসলে শরীরের ভেতরের কোনো অঙ্গ (প্রধানত অন্ত্র বা চর্বি), পেশীর দুর্বল অংশ দিয়ে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। এই অবস্থাকেই বলা হয় হেরনিয়া।
এটি শুধু পেটের সমস্যা নয় — এটি এমন একটি শারীরিক অস্বস্তি, যা শরীরের কাঠামোগত দুর্বলতার পরিচায়ক।
➤ শরীরের কোন জায়গায় হতে পারে হেরনিয়া?
হেরনিয়া বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে, এবং প্রতিটি ধরনের আছে আলাদা বৈশিষ্ট্য ও ঝুঁকি:
⇨ ইনগুইনাল হেরনিয়া (Groin-এর দিক): পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পেটের নীচের দিকে, কুঁচকির জায়গায় অন্ত্রের অংশ পেশির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।
⇨ ইউমবিলিকাল হেরনিয়া (নাভির আশেপাশে): শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের পর দেখা যেতে পারে। মহিলাদের গর্ভধারণের পরেও হতে পারে।
⇨ ফেমোরাল হেরনিয়া: মূত্রথলির নিচের দিকে, উরুর কাছাকাছি হয়। মহিলাদের বেশি ঝুঁকি থাকে।
⇨ ইনসিশনাল হেরনিয়া: আগের কোনো অপারেশনের জায়গা দুর্বল হয়ে গেলে, সেই দাগের পাশ দিয়ে অঙ্গ বেরিয়ে আসে।
⇨ হায়েটাল হেরনিয়া (অন্ত্রে নয়, খাদ্যনালীর দিকে): পেটের অঙ্গ বুকের মধ্যে উঠে আসে — বুক জ্বালাপোড়া, অ্যাসিডিটি, এমনকি শ্বাসকষ্ট হয়।
➤ কেন হয় হেরনিয়া? জানুন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা
হেরনিয়া মূলত ঘটে শরীরের পেশী বা টিস্যুর কোনো দুর্বল অংশ দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাপ বেরিয়ে গেলে। কারণগুলো হচ্ছে:
⇨ অতিরিক্ত ভার উত্তোলন — যেমন হঠাৎ করে ভারী কিছু তোলা
⇨দীর্ঘমেয়াদি কাশি — ফুসফুসের রোগীদের বেশি ঝুঁকি
⇨ কোষ্ঠকাঠিন্য ও মলত্যাগের সময় চাপ দেওয়া
⇨ গর্ভাবস্থা ও সন্তান জন্মদানের পর পেটের চাপ বেড়ে যাওয়া
⇨ স্থূলতা ও পেটের অতিরিক্ত চর্বি
⇨ জন্মগত পেশির দুর্বলতা বা বয়সজনিত টিস্যু ক্ষয়
অপারেশনের ভুল টেকনিক বা অপচর্চা
➤ উপসর্গে যা দেখা যায়
হেরনিয়ার উপসর্গ রোগ অনুযায়ী ভিন্ন হলেও সাধারণত দেখা যায়:
⇨কোনো একটি স্থানে নরম, ধাক্কা দিলে নড়ানো যায় এমন ফোলাভাব
⇨ হাসলে, কাশি দিলে বা ভার তোলার সময় ফোলাভাব বাড়ে
⇨ শুয়ে পড়লে কিছুটা কমে যেতে পারে
⇨ কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা হয় বা টান লাগে
⇨ 'স্ট্র্যাঙ্গুলেটেড হেরনিয়া' হলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অংশটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে — যা জরুরি অস্ত্রোপচার না করলে জীবন বিপন্ন করতে পারে
➤ কীভাবে নিশ্চিত হবেন?
শুধু বাইরের লক্ষণ নয়, হেরনিয়া সনাক্তে প্রয়োজন হতে পারে:
⇨ শারীরিক পর্যবেক্ষণ
⇨ আল্ট্রাসনোগ্রাফি (USG)
⇨ CT Scan বা MRI (জটিল ক্ষেত্রে)
➤ চিকিৎসা কী?
হেরনিয়া ওষুধে ভালো হয় না — একমাত্র সমাধান অপারেশন (Hernia Repair Surgery)। বর্তমানে রয়েছে অত্যাধুনিক পদ্ধতি:
⇨ ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি: ছোট কাটা, দ্রুত সুস্থ হওয়া
⇨ Mesh Repair (মেশ বসানো): দুর্বল অংশে একটি কৃত্রিম জাল বসানো হয়, যাতে আর কিছু ঠেলে না বেরোয়
⇨ খোলা অপারেশন (Traditional Open Surgery): জটিল বা বড় হেরনিয়ার ক্ষেত্রে
➤ প্রতিরোধে যা করবেন
হেরনিয়া পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও, কিছু নিয়ম মানলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়:
⇨ নিয়মিত ব্যায়াম, যাতে পেশি থাকে শক্ত
কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া
⇨ হঠাৎ ভার উত্তোলন না করা
⇨ গর্ভাবস্থায় শারীরিক সচেতনতা
⇨ অপারেশনের পরে পেটের চাপ এড়িয়ে চলা
⇨ ধূমপান বন্ধ — কারণ এটি পেশী দুর্বল করে এবং কাশি বাড়ায়
➤ গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হেরনিয়াকে ভুল ব্যাখ্যা করে কেউ কেউ গ্রাম্য ওষুধ, মালিশ বা বাঁধন দিয়ে সারানোর চেষ্টা করেন। এতে হেরনিয়া 'ঢুকে' যেতে পারে, কিন্তু তা এক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অন্ত্রে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ইনফেকশন, গ্যাংগ্রিন, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সচেতন থাকুন, জীবন বাঁচান
"হাঁড় বের হওয়া" বলে উপেক্ষা করার কিছু নয় — এটি হতে পারে আপনার শরীরের দেওয়া প্রথম বিপদের সংকেত। ভয় পাবেন না, কিন্তু অবহেলাও করবেন না। সময়মতো চিহ্নিত হলে, আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নত পদ্ধতিতে হেরনিয়া ১০০% ভালো হওয়া সম্ভব।
সতর্ক দৃষ্টিতে নিজের শরীরকে বুঝুন - কারণ হেরনিয়া চুপিচুপি আসে, কিন্তু সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে তার চিৎকার সারাজীবনের যন্ত্রণা হয়ে যেতে পারে।