প্রযুক্তির মায়াজালে আটকা পড়া সমাজ!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একটা সময়ে সন্ধ্যা মানেই পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা, খেলাধুলা আর চোখে চোখ রেখে কথা বলার আনন্দ। এখন সেই দৃশ্য পাল্টে গেছে। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ—সবাই এক একটি স্ক্রিনে মুখ গুঁজে বসে আছে। বাস্তবের সংযোগ কমে আসছে, কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে সক্রিয়তা পৌঁছেছে চূড়ায়।
তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে মানুষ যেমন লাভবান হয়েছে, তেমনি একটি অপ্রকাশ্য নেশায়ও জড়িয়ে পড়েছে-প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি।এই আসক্তি এখন মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্পর্ক এবং জীবনের গতিপথে গভীর ছাপ ফেলছে, যার পরিণতি হতে পারে বহু স্তরের জটিলতা।
➤ সোশ্যাল মিডিয়া: নোটিফিকেশনের ফাঁদে ফেলা ডিজিটাল লোভ
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগোরিদম এমনভাবে তৈরি, যা ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখতে দারুণ দক্ষ। প্রতিটি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বা নতুন ফলোয়ারের মাধ্যমে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক 'ফিল গুড' কেমিক্যালের ক্ষরণ হয়। এটি ঠিক একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যেমনটি ঘটে জুয়া বা নিকোটিন আসক্তিতে।
একবার এই রিওয়ার্ড সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ব্যবহারকারীরা দিনে বহুবার ফোন চেক করেন, প্রায় অজান্তেই। একে বলে "বিহেভিয়োরাল অ্যাডিকশন" – অভ্যাস গঠনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মানসিক নির্ভরতা। এই অভ্যাস অতি ধীরে ধীরে জীবনের অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজকে চাপা দিয়ে দেয়।
➤ পরিসংখ্যানে ভয়াবহ বাস্তবতা
এক জরিপ অনুযায়ী,
⇨ বিশ্বজুড়ে একজন মানুষ গড়ে দিনে ৬.৫ ঘণ্টা ইন্টারনেটে কাটান, যার মধ্যে প্রায় ২.৫ ঘণ্টা শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ায়।
⇨ তরুণদের মধ্যে এই সময় আরও বেশি-বিশেষ করে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা দিনে প্রায় ৩–৪ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়।
⇨ অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম ঘুমের সমস্যা, চোখের চাপ, পিঠ ও ঘাড়ের ব্যথা সৃষ্টি করে এবং এক পর্যায়ে হতাশা ও উদ্বেগ তৈরি করে।
➤ বিজ্ঞান যা বলছে: প্রযুক্তি নির্ভরতা কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে?
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি শুধু হতাশা নয়-"FOMO (Fear of Missing Out)" বা "অন্যরা কী করছে, আমি যেন কিছু মিস না করি"-এই মানসিক চাপ প্রতিনিয়ত উদ্বেগ তৈরি করে। এছাড়া, "কম্প্যারেটিভ ইনফিরিয়রিটি" বা অন্যদের 'পারফেক্ট' জীবন দেখে নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভাবার প্রবণতা বেড়েছে মারাত্মক হারে।
এমনকি শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্কে প্রযুক্তির প্রভাব আরও গভীর। নিউরোসায়েন্সের মতে, নিয়মিত অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের একাগ্রতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
➤ সমাধান কী হতে পারে? প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে-
প্রযুক্তি থেকে পুরোপুরি সরে যাওয়া অবাস্তব। কিন্তু সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হতে পারে এই আসক্তি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী:
⇨ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় "ডিজিটাল ডিটক্স" পালন করুন।
⇨ রাতে শোবার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল-কম্পিউটার স্ক্রিন বন্ধ করুন।
⇨ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন।
⇨ রিয়েল লাইফে সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষা করার চেষ্টা করুন-পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করা এসব মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
➤ প্রযুক্তি হোক নিয়ন্ত্রিত, নয়তো ভবিষ্যত হবে অনিয়ন্ত্রিত
প্রযুক্তি মানুষকে সংযুক্ত করেছে, কিন্তু সেই সংযোগ যদি নিঃসঙ্গতা তৈরি করে, তবে সেটি উন্নয়ন নয়-একটি বিপর্যয়। আমাদের এখনই চিন্তা করতে হবে, প্রযুক্তির আমরা কতটা ব্যবহার করছি, আর প্রযুক্তি আমাদের কতটা ব্যবহার করছে।
স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব-এসব স্মার্ট ডিভাইস আমাদের সময়, মনোযোগ, এমনকি আত্মপরিচয় পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলছে।
এখনই সময় নিজেকে প্রশ্ন করার-"আমি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, না প্রযুক্তি আমাকে ব্যবহার করছে?"