পঞ্চাশ বছর পর, আবারও চাঁদের দিকে এগিয়ে চলেছে মানবজাতি

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মহাকাশ কূটনীতির অভূতপূর্ব অভিযানে
পঞ্চাশ বছর পর, আবারও চাঁদের দিকে এগিয়ে চলেছে মানবজাতি
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

চাঁদ-যে গন্তব্য একদিন ছিল স্বপ্ন, পরে পরিণত হয়েছিল গর্বে, আর এখন তা হচ্ছে ভবিষ্যতের একটি কৌশলগত মঞ্চ। আজ, আধুনিক বিজ্ঞান ও কৌশলগত মহাকাশ প্রতিযোগিতার যুগে, NASA-এর Artemis প্রোগ্রাম আমাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে সেই জায়গায়, যেখানে এক সময় মানুষ প্রথমবারের মতো অন্য গ্রহে পা রেখেছিল। তবে এই ফিরে যাওয়া আর 'শুধু ফেরা' নয়-এটা এক নতুন অভিযাত্রার শুরু।

ইতিহাস: ১৯৬৯ সালের সেই প্রথম 'এক ছোট পা'

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই, Apollo 11 মিশনে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখেন-"That's one small step for man, one giant leap for mankind"-এই বাক্য চিরকাল ইতিহাস হয়ে থাকবে। পরবর্তী তিন বছরে Apollo 12 থেকে Apollo 17 পর্যন্ত মোট ১২ জন নভোচারী চাঁদে অবতরণ করেন। তারা চাঁদের মাটি, পাথর, ভূত্বক বিশ্লেষণ করেন যা আজও বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্তম্ভ।

তবে ১৯৭২ সালের পর থেকে মানুষ আর চাঁদে যায়নি। মূলত প্রযুক্তি, ব্যয় ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার পাল্টে যাওয়ার কারণে চন্দ্রযাত্রা থেমে যায়। কিন্তু সেই বিরতি আজ ভাঙতে চলেছে।
 

Artemis: ফিরে যাওয়া নয়, এগিয়ে যাওয়া

NASA-এর Artemis প্রোগ্রাম এক নতুন যুগের সূচনা করছে। এটি শুধু আরেকটি চন্দ্রাভিযান নয়-এটি একটি টেকসই চন্দ্র-মিশন গড়ে তোলার রোডম্যাপ।
 

Artemis-এর মূল লক্ষ্য:

⇨ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ (যেখানে এখনও মানুষ পা রাখেনি)

⇨ নারী ও বর্ণবিদ্বেষ-বঞ্চিত সম্প্রদায় থেকে প্রথম

⇨ নভোচারী চাঁদে পাঠানো

⇨ চাঁদে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা স্টেশন স্থাপন

⇨ মঙ্গলগ্রহে যাত্রার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চাঁদকে 'সফট লঞ্চপ্যাড' হিসেবে ব্যবহার
 

প্রযুক্তির বিপ্লব: আগের চেয়ে স্মার্ট, টেকসই ও বৈশ্বিক

Apollo যুগে অভিযান ছিল দ্রুত এবং সীমিত সময়ের জন্য। কিন্তু Artemis যুগে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত রূপ:

⇨ Orion ক্যাপসুল, যা দীর্ঘ সময় মহাকাশে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম

⇨ Space Launch System (SLS)-বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট

⇨ Gateway নামের একটি ছোট স্পেস স্টেশন, যা চাঁদের কক্ষপথে ঘুরবে এবং অভিযাত্রীদের চাঁদের পৃষ্ঠে যাত্রা সহজ করবে

⇨ SpaceX-এর Human Landing System, যা মানুষকে সরাসরি চাঁদে নামাবে
 

বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব ও মহাকাশ কূটনীতি

এই অভিযানে একা NASA নয়। ইউরোপ (ESA), জাপান (JAXA), কানাডা (CSA) সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশ নিচ্ছে। এছাড়াও SpaceX, Blue Origin, Astrobotic-এর মতো বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলো যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর হাত ধরেই মহাকাশ এখন একটি পাবলিক-প্রাইভেট ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়েছে।

এই বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি মহাকাশ সংক্রান্ত আইনি কাঠামো (Artemis Accords) তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
 

কেন আবার চাঁদ?

চাঁদ এখন কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়-এটি শক্তি, তথ্য ও ভূ-রাজনৈতিক দখলদারিত্বের নতুন কেন্দ্র।

⇨ চাঁদের South Pole অঞ্চলে জলের বরফ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যতের মহাকাশ বসতির জন্য অপরিহার্য।

⇨ চাঁদের পাথরে Helium-3 নামে একটি সম্ভাব্য নিউক্লিয়ার ফিউশন ফুয়েল আছে, যা পৃথিবীতে শক্তির সমস্যার বিকল্প হতে পারে।

⇨ চাঁদকে ব্যবহার করা হচ্ছে মঙ্গল ও আরও দূরবর্তী অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি হিসেবে।
 

ভবিষ্যত: চাঁদ থেকে শুরু, মঙ্গল পর্যন্ত

NASA-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ সালে Artemis II মিশনে নভোচারীরা চাঁদ প্রদক্ষিণ করবেন, আর Artemis III হবে চাঁদের মাটিতে ফের মানব পদচিহ্ন রাখার ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

পরবর্তী দশকে চাঁদে স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র, রোবটিক ও মানব হাব এবং রিফুয়েলিং স্টেশন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত উদ্যোগের মাধ্যমে চাঁদ হয়ে উঠবে একটি মহাকাশ হাব, যেখান থেকে মঙ্গল কিংবা আরও দূরবর্তী গ্রহে যাত্রা করা সম্ভব হবে।

Artemis অভিযান শুধু মহাকাশে ফেরা নয়-এটা এক প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রতীক। অর্ধ শতাব্দী আগে শুরু হওয়া চন্দ্রযাত্রা এখন এক নতুন রূপ নিচ্ছে-আর সেই রূপটাই হতে পারে মানবজাতির প্রথম আন্তঃগ্রহ সভ্যতার সূচনা।


সম্পর্কিত নিউজ