মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে কোরবানির আদর্শ ও তার বাস্তব দৃষ্টান্ত

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ইসলামে কোরবানি শুধু হজ বা ঈদের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং তাওহিদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটি প্রতীকী নিদর্শন, যার শেকড় গাঁথা মানব জাতির সূচনালগ্নেই। কোরআন এবং হাদিস-দুই প্রধান উৎসেই এই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। কোরবানির সূচনা হযরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের সময় থেকেই শুরু হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
"আর তুমি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সত্যসহ শুনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল, তন্মধ্যে একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অপরেরটি কবুল হলো না।" 📖 (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৭)
এই আয়াত থেকেই কোরবানির প্রাথমিক ধারণা স্পষ্ট হয়—আল্লাহ তা'আলা যার নিয়ত ও আমলকে পছন্দ করেন, কেবল তার কোরবানি গ্রহণ করেন এবং কোরবানির সূচনা মানব ইতিহাসের প্রথম যুগ থেকেই চালু ছিল। তবে ইসলাম ধর্মে কোরবানির রীতি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে, আর এর চূড়ান্ত রূপ ও বাস্তব অনুসরণ আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে দেখা যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী কোরবানি :
রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানিকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি পন্থা হিসেবে দেখেছেন।
তিনি বলতেন, "এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।" (ইবনে মাজাহ: ৩১২৭)
হাদিস শরিফে এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন:
"ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই কোরবানি কী?"
তিনি উত্তরে বলেন: "এটি হচ্ছে তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত।" (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৭ | সহিহ হাদিস হিসাবে ইমাম নওববী ও অন্যান্য হাদিস বিশারদ একে গ্রহণ করেছেন)
এই হাদিসে কোরবানির ঐতিহাসিক ভিত্তি ও ধর্মীয় গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
➤কোরবানির ধারাবাহিকতা: প্রতি বছর পালন করতেন মহানবী (সা.)
তিরমিজি শরিফের (হাদিস: ১৫০৭) বর্ণনায় এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন—"রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর ছিলেন এবং প্রতি বছর কোরবানি করতেন।"
ইবনু 'উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ" রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যবেহ করতেন এবং নহর করতেন।" (বুখারি হাদিস: ৫৫৫২)।
➤দুটি ভেড়া কোরবানি: নিজের ও উম্মতের জন্য
মহানবী (সা.) শুধু নিজের জন্য নয়, তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকেও পশু কোরবানি করতেন।
হাদিসে আছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন-"নবী করিম (সা.) দুটি শিংওয়ালা, সাদা ও কালো রঙের ভেড়া কোরবানি দিতেন। একটি নিজের পক্ষ থেকে, অন্যটি উম্মতের পক্ষ থেকে।" (বুখারি: ৫৫৫৩)
আয়েশা (রাঃ) ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর ইচ্ছা করলে দু'টি মোটাতাজা, মাংসল, শিংযুক্ত, ধুসর বর্ণের ও ছিন্নমুষ্ক মেষ ক্রয় করতেন। অতঃপর এর একটি নিজ উম্মাতের যারা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁর নবুয়াতের সাক্ষ্য দেয় তাদের পক্ষ থেকে এবং অপরটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে কোরবানী করতেন। (ইবনে মাজাহ: ৩১২২)
➤হজের সময় স্ত্রীদের পক্ষ থেকেও কোরবানি
বিদায় হজের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকেও গরু কোরবানি করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন-"রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের পক্ষ থেকে গরু কোরবানি করেছেন।" (বুখারি: ১৭০৯)
➤কোরবানির গোশত বণ্টনের মানবিক নিয়ম
"আর (কুরবানীর) উঁটকে করেছি আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় ওগুলির উপর (নহর করার সময়) তোমরা আল্লাহর নাম নাও। অতঃপর যখন ওরা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা তা হতে আহার কর এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও যাচ্ঞাকারী অভাবগ্রস্তকে। এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।" (সূরা হাজ্জ ৩৬ আয়াত)
রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করতেন ।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (কুরবানীর মাংস) তোমরা খাও, জমা কর, এবং দান কর।'' তিনি আরো বলেন, ''তা খাও, খাওয়াও এবং জমা রাখ।''(মুসলিম ১৯৭১নং)
উপর্যুক্ত আয়াত বা হাদীসে খাওয়া, হাদিয়া দেওয়া ও দান করার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ বিবৃত হয়নি। তবে অধিকাংশ উলামাগণ মনে করেন যে, সমস্ত মাংসকে তিন ভাগ করে এক ভাগ খাওয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং এক ভাগ গরীবদেরকে দান করা উত্তম।
কোরবানির ইতিহাস যতই পেছনে যাওয়া হোক না কেন, এটি আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ত্যাগের নিদর্শন। হাবিল ও কাবিলের কোরবানির মাধ্যমে যে সূচনা হয়েছিল, তা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে।
আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে মুসলিম সমাজ যেন কোরবানির মূল শিক্ষা—আত্মত্যাগ, আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দেয়, সেটাই আজকের দিনের বাস্তব চেতনা হওয়া উচিত।