কুরবানির পশু জবাইয়ের ইসলামী পদ্ধতি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঈদুল আজহা কেবল আনন্দ-উৎসবের দিন নয়, বরং ত্যাগ, কৃতজ্ঞতা এবং আনুগত্যের শিক্ষা দেয় ইসলামি সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ দিনে কুরবানির পশু জবাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার রয়েছে নির্দিষ্ট শরয়ি নিয়ম ও মানবিক দিকনির্দেশনা। ইসলামী পদ্ধতি যেমন গুরুত্বের দাবি রাখে, তেমনি আধুনিক সময়ের স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশসুরক্ষা ও মানবাধিকার বিবেচনাও হয়ে উঠেছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
➤ইসলামী শরিয়তের নির্ধারিত জবাই পদ্ধতি
ইসলামে কুরবানির জবাই একটি ইবাদত, যা সঠিক নিয়মে সম্পন্ন না হলে তা সহিহ হয় না। হাদিস ও ফিকহশাস্ত্র অনুসারে কুরবানির সঠিক পদ্ধতি হলো:
১. আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা: আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি সাদা-কালো রং এর ভেড়া দ্বারা কুরবানী করেছেন। তখন আমি তাঁকে দেখতে পেলাম তিনি ভেড়া দু'টোর পার্শ্বে পা রেখে 'বিস্মিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার' পড়ে তাঁর নিজ হাতে সে দু'টোকে যবেহ করেন।" (সহিহ বুখারি: ৫৫৫৮)
যবেহকালে আল্লাহর নাম নেওয়া ('বিসমিল্লাহ' বলা) ওয়াজেব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ''যদি তোমরা তাঁর নিদর্শনসমূহের বিশ্বাসী হও তবে যাতে (যে পশুর যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা আহার কর।'' (কুঃ ৬/১১৮) ''এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার করো না; উহা অবশ্যই পাপ।'' (কুঃ ৬/১২১)
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ''যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর।''(বুখারী ২৩৫৬, মুসলিম ১৯৬৮নং)
'বিসমিল্লাহ'র সাথে 'আল্লাহু আকবার' যুক্ত করা মুস্তাহাব। অবশ্য এর সঙ্গে কবুল করার দুআ ছাড়া অন্য কিছু অতিরিক্ত করা বিধেয় নয়। অতএব (কুরবানী কেবল নিজের তরফ থেকে হলে) বলবে, 'বিসমিল্লাহি অল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিন্কা অলাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী।'
নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে,'---তাক্বাববাল মিন্নী অমিন আহলে বাইতী।' অপরের নামে হলে বলবে, '---তাক্বাববাল মিন (এখানে যার তরফ থেকে কুরবানী তার নাম নেবে)(মানাসিকুল হাজ্জ, আলবানী ৩৬পৃঃ)
এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠ করা বিধেয় নয়; বরং তা বিদআত।(আল-মুমতে ৭/৪৯২)
যেমন 'বিসমিল্লাহ'র সাথে 'আর-রাহমানির রাহীম' যোগ করাও সুন্নত নয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে কোন দলীল নেই। যেমন যবেহ করার লম্বা দুআ 'ইন্নী অজ্জাহ্তু' এর হাদীস যয়ীফ। (যয়ীফ আবূ দাঊদ ৫৯৭নং)
যবেহর ঠিক অব্যবহিত পূর্বে 'বিসমিল্লাহ' পাঠ জরুরী।
২। কুরবানী যদি উঁট হয়, (অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়), তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ''সুতরাং দন্ডায়মান অবস্থায় ওদের যবেহকালে তোমরা আল্লাহর নাম নাও।'' (কুঃ ২২/৩৬)
ইবনে আববাস (রা.) এই আয়াতের তফসীরে বলেন, 'বাম পা বেঁধে তিন পায়ের উপর দন্ডায়মান অবস্থায় (নহর করা হবে)।'(তাফসীর ইবনে কাষীর)
যদি উঁট ছাড়া অন্য পশু হয় তাহলে তা বামকাতে শয়নাবস্থায় যবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান হাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। তবে যদি যবেহকারী নেটা বা বেঁয়ো হয় তাহলে সে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করতে পারে। যেহেতু সহজ উপায়ে যবেহ করা ও পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্য।
পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা মুচ্ড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।
৩। ধারালো ছুরি ব্যবহার: প্রাণীকে কম কষ্ট দিয়ে জবাই করাই ইসলামের শিক্ষা। এ বিষয়ে দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ''অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর উপর অনুগ্রহ লিপিবদ্ধ (জরুরী) করেছেন। সুতরাং যখন (জিহাদ বা হদ্দে) হত্যা কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে হত্যা কর এবং যখন যবেহ কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে যবেহ কর। তোমাদের উচিত, ছুরিকে ধারালো করা এবং বধ্য পশুকে আরাম দেওয়া।'' (মুসলিম ১৯৫৫নং)
৪। ঘাড়ের নিচের অংশ (গলা) কেটে চারটি রগ ছেদন করা: যবেহতে খুন বহা জরুরী। আর তা দুই শাহরগ (কন্ঠনালীর দুই পাশে দু'টি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ''যা খুন বহায়, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর। তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়।'' (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি, সহীহুল জামে' ৫৫৬৫নং)
৫। কিবলামুখী করে জবাই করা: যবেহকালে পশুকে কেবলামুখে শয়ন করাতে হবে।(আবূ দাঊদ, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৩, হাদীসটির সনদে সমালোচনা করা হয়েছে)
অন্যমুখে শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু কেবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজেব হওয়ার ব্যাপারে কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই।(আহকামুল উযহিয়্যাহ ৮৮,৯৫পৃঃ)
৬। জবাইয়ের পর পশুর প্রাণ পুরোপুরি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত কাটা-কাটি বন্ধ রাখা।
প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। অনুরূপভাবে দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যেহেতু অন্যভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।
যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
➤ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরবানির গুরুত্ব
বর্তমান বিশ্বে কুরবানির সময় কিছু বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে:
১। স্বাস্থ্যবিধি ও হাইজিন: পশু জবাইয়ের জায়গা, যন্ত্রপাতি ও মাংস প্রক্রিয়াকরণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। সংক্রমণরোধ ও রোগ প্রতিরোধে আধুনিক পশু চিকিৎসাবিজ্ঞান এই দিকটিকে খুব গুরুত্ব দেয়।
২। পরিবেশ রক্ষা: রক্ত, আবর্জনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পৌরসভা ও ব্যক্তি উভয়কেই সচেতন হতে হচ্ছে। ইসলামও পরিবেশকে পরিশুদ্ধ রাখার তাগিদ দিয়েছে।
"নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র; তিনি পবিত্রতাই পছন্দ করেন।" (তিরমিজি: ২৭৯৯)
৩। পশু অধিকার: পশুকে অকারণে কষ্ট দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ।
সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি উটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, অনাহারে উটটির পেট পিঠের সাথে লেগে গিয়েছিলো। তিনি বললেনঃ তোমরা এসব বাকশক্তিহীন পশুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ সবল পশুর পিঠে আরোহণ করবে এবং এদেরকে উত্তমরূপে আহার করাবে। (আবু দাউদ: ২৫৪৮)
➤ইসলামী বিধান বনাম আধুনিক বিজ্ঞান—একটি ভারসাম্য
বিশ্বের অনেক ইসলামিক স্কলার ও পশু বিজ্ঞানী একমত যে ইসলামী পদ্ধতিতে জবাই প্রাণীর কম কষ্ট হয় এবং এটি স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও নিরাপদ। আধুনিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, হালাল পদ্ধতিতে জবাইকৃত পশুর মাংসে রক্ত কম থেকে যায়, ফলে এটি অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।
ইসলামী পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করেই আধুনিক বিজ্ঞান ও সমাজের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তাই কুরবানির সময় শরিয়তের নির্দেশনা ও আধুনিক স্বাস্থ্যবিধির সমন্বয়ে একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।